লিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে বোঝাপড়ার খামতিগুলো
সমাজ

ছবি-সংগৃহীত
জোবাইদা নাসরীন
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ | ২৩:০৬ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ | ১২:৪৬
বাংলাদেশে স্বীকৃতির ১০ বছর পর জাতীয় ইস্যু হয়ে উঠেছে ‘হিজড়া’। ২০১৩ সালে সরকার নারী ও পুরুষের পাশাপাশি ‘হিজড়া লিঙ্গ’ স্বীকৃতি দেয়। যদিও এর দাপ্তরিক সংজ্ঞায়ন না থাকায় সমাজে জারি থাকা ভ্রান্ত ধারণাগুলো আরও প্রকট হচ্ছে। এ কথা বলাও আযৌক্তিক হবে না যে, লিঙ্গ বৈচিত্র্য বিষয়ে বিভিন্ন স্তরের নাগরিকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা থাকার কারণ যৌনতা, লিঙ্গ বৈচিত্র্য– এগুলো নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সমাজে বিরাজমান সংস্কার আরও জেঁকে বসে আছে। বাড়তি পাওনা ঔপনিবেশিক মন, যেখানে নারী-পুরুষের বাইরে থাকা অন্যান্য লিঙ্গীয় পরিচয়ের মানুষের প্রতি এক ধরনের অবমাননার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু মোগল আমলে এসব মানুষের ছিল বিশেষ মর্যাদা। শাসকদের উপদেষ্টা হিসেবে তারা নিয়োগ পেত। কারণ ধরে নেওয়া হতো যে, এদের মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক আইনে শুধু নারী এবং পুরুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ফলে উপমহাদেশজুড়ে এই জনগোষ্ঠী অনেকটাই অধিকারহীন হয়ে পড়ে।
এখানে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়। এবারে জাতীয় নির্বাচনেই রংপুরে একজন লিঙ্গ বৈচিত্র্যের প্রার্থী ছিলেন এবং তিনি নানা ধরনের প্রতিকূলতা পেরিয়েও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করেছেন। পাশাপাশি এই সময়ে একজন কূটনীতিক তাঁর নিজের লিঙ্গ পরিচয় সবার কাছে প্রকাশ করে অভিনন্দিত হয়েছেন। এই দুটো ঘটনা নিঃসন্দেহে এ দেশে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু ‘হিজড়া’ এবং ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বিষয়টি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হলো অন্য কারণে।
প্রথমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের একজন বক্তাকে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ না দেওয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর থেকে চালু হওয়া ‘হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কোটা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন; সর্বশেষ সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ‘শরীফার গল্প’কে কেন্দ্র করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলা এবং এই বিষয়ে নেতিবাচক ও ভুল ধারণাগুলো আবারও সামনে নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে আমরা আরও বেশি আক্রান্ত হই যখন দেখি নারী-পুরুষ পরিচয়ের লোকজন জান দিয়ে লড়ছে এই পরিচয়ের বাইরে থাকা মানুষদের ঠেকাতে।
প্রথমেই এই বিষয়ে মূল সমস্যাগুলোর একটির দিকে আলোকপাত করতে চাই। তা হলো বোঝাপড়ার সমস্যা। এই ‘হিজড়া’ কারা? সরকারিভাবে এবং বেশির ভাগ মানুষই এই বোঝাপড়ায় আন্তঃলিঙ্গের, অর্থাৎ যাদের শরীরে নারী ও পুরুষ অঙ্গ বিদ্যমান, সঙ্গে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষদের তালগোল পাকিয়ে ফেলে। স্পষ্টই জানান দেওয়া প্রয়োজন, লিঙ্গ বৈচিত্র্য কোনো শারীরিক বিষয় নয়। এটি পুরোটাই লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের বিষয়। এ বিষয়ে পরিষ্কার বোঝাপড়া না থাকার কারণে আমরা দেখেছি এই জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া সরকারের বেশ কিছু পরিকল্পনাই ভেস্তে গেছে। হিজড়া সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের ভ্রান্ত ধারণায় এদের যৌনাঙ্গ অপরিণত কিংবা স্পষ্ট নয়। হিজড়া আসলে কোনো পরিচয় নয়। এটি একটি সংস্কৃতি, একটি গুরু-পরম্পরা সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিতে বিভিন্ন যৌন এবং লিঙ্গীয় পরিচয়ের লোকজন বেড়ে ওঠে। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী ও পুরুষদের বাইরে লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠী ‘হিজড়া’ হিসেবেই পরিচিত।
আমাদের দেশে মিডিয়া ও জনগণের কাছে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বা ‘থার্ড জেন্ডার’ টার্মটি জনপ্রিয়। যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধান কোনো লিঙ্গকে প্রথম এবং দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে অভিহিত করেনি তাই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয় অনেকটাই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটিও ‘হিজড়া’র প্রতিশব্দ হিসেবেই এ দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ টার্মটির ব্যবহার নিয়েও ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে। অনেকের ধারণা, যারা অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তন করে তারা ট্রান্সজেন্ডার। এটিও ভ্রান্ত ধারণা। ট্রান্সজেন্ডার হলো, যাদের জন্ম থেকে প্রাপ্ত যৌন পরিচয় এবং লিঙ্গীয় পরিচয় এক নয়। ইংরেজিতে বললে হয়তো বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। যেমন ‘মেইল’ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই সবাই ‘ম্যান’ হবে, তা নয়। মেইল হয়েও কেউ কেউ ‘উওম্যান’ বোধ করতে পারে। ঠিক একইভাবে ‘ফিমেল’ হয়ে জন্মগ্রহণ করেও কেউ নিজেকে ম্যান ভাবতে পারে। ট্রান্সজেন্ডার বোঝাপড়ার মূল যুক্তিই হলো মেইল আর ম্যানের পার্থক্য বুঝতে পারা। উদাহরণটি ইংরেজিতে দেওয়ার কারণ হলো, বাংলা ভাষায় ‘সেক্স’ এবং ‘জেন্ডার’ অনুবাদ একই। তাই পার্থক্যটা অনেক সময়ই বোঝা যায় না। যারা লিঙ্গ পরিবর্তন করে তারা হলো ‘ট্রান্সসেক্সুয়াল’।
অনেকেই বলছেন, ট্রান্সজেন্ডার মানে সমকামিতা। এটিও ঠিক নয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, যদিও একাডেমিকভাবে হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার বোঝাপড়া আলাদা, কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুটো টার্ম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ একেবারেই নেই।
কেউ কেউ বলছেন, ট্রান্সজেন্ডার পাশ্চাত্য থেকে আসা। বাস্তবে আমাদের এ অঞ্চলে নারী-পুরুষের বাইরে বিভিন্ন ধরনের যৌন এবং লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের মানুষের অস্তিত্ব ছিল। ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ পাকিস্তান অনেক আগেই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ হিসেবে এই জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি ২০১৬ সালে পাকিস্তান শরিয়াহ বোর্ড ট্রান্সজেন্ডার বিয়ে বৈধ বলে ঘোষণা দেয়। যদিও কয়েকটি ইসলামী দল এ বিষয়ে রিট করার কারণে এটি এখনও কার্যকর হয়নি।
এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এই দুটো টার্ম একই অর্থে রাখা হয়েছে? আমরা মনে করি, আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, তারা আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবে। সেখানে ‘হিজড়া’ পরিচয় হয়তো অনেকেই বুঝবে না। কারণ, এটি একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত টার্ম। তাই হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার টার্ম রাখা হয়েছে। এটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপকে খারিজ করার সুযোগ নেই। এ দেশে হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার এবং থার্ড জেন্ডার (তৃতীয় লিঙ্গ) একই অর্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিষয়ে সবার সঠিক বোঝাপড়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
- বিষয় :
- তৃতীয় লিঙ্গ
- হিজড়া