দেয়াললিখন ও তৎসংক্রান্ত রাজনীতি

বহিস্কৃত ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতা।
শিবলী নোমান
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২৩:১৫
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা ডালপালা মেলেছে। নতুন ঘটনা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের বাইরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়ালচিত্র মুছে তার ওপর ধর্ষণবিরোধী দেয়ালচিত্র অঙ্কনের অভিযোগে দুই বাম ছাত্রনেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এহেন আচরণকে অনেকেই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তথা ছাত্রলীগের প্রতি উস্কানিমূলক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর চিত্র মুছে ফেলার বিষয়টিকে জাতির পিতার অবমাননা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। তবে পুরো বিষয়টিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্টতাকে লালন করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান।
মনে পড়ে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দেয়ালে জাতির পিতার এক বিশাল চিত্র আঁকা হয়েছিল, জানি না সেটি এখনও আছে কিনা বা থাকলেও কী অবস্থায় আছে। তবে যারা সেই দেয়ালচিত্রটি এঁকেছিলেন, সেই দলে আমার কাছের বন্ধুও থাকায় দারুণ তৃপ্তি বোধ করেছিলাম, এখনও করি। কিন্তু নতুন কলাভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত দেয়ালচিত্র মুছে ফেলার ঘটনাটির বিরুদ্ধে যেরূপ সরল বয়ান তৈরির প্রয়াস দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে একমত হওয়া আসলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার শামিল। ফলে এটি বিপজ্জনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের যে স্থানে ওই দেয়ালচিত্রটি ছিল, স্মৃতি ঘাটলে দেখা যাবে ২০১৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে চলমান আন্দোলনের সময় ঠিক সেই স্থানে দিনের আলোয় একটি ক্যারিকেচার এঁকেছিল সে সময়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। সেই ক্যারিকেচারটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের বাস্তবতাতেই নানাভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল না, বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক যুগের শিক্ষক রাজনীতির সিলসিলার এক দারুণ রূপায়নও ছিল।
তবে সেই সময়ের আন্দোলনটি কিছুটা থিতু হওয়ার খুব অল্প সময়ের ভেতর মুজিব শতবর্ষকে উপলক্ষ করে সেই ক্যারিকেচারটির ওপর হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত দেয়ালচিত্রটি আঁকা হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্রটি কারা এঁকেছেন তার কোনো উল্লেখ ছিল না। ফলে বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে আগের ক্যারিকেচারটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন সামনে আসতে পারে।
তবে উপলক্ষ যা-ই হোক, কিছুদিন ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমতের প্রকাশ হিসেবে দেয়াললিখন ও দেয়ালচিত্রগুলোর কণ্ঠরোধ করার জন্য এহেন বিরোধী লিখন বা চিত্রের ওপর বঙ্গবন্ধু বা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কিত দেয়ালচিত্র এঁকে দেওয়া বা কিছু লিখে দেওয়া বেশ সাধারণ একটি প্রবণতা হিসেবে সামনে এসেছে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্র মুছে তার ওপর অন্য যে কোনো চিত্রাঙ্কন বা দেয়াললিখনকে খুব সহজেই জাতির পিতার অবমাননার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ হলো, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনেই বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বিশাল দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে। আর এটিও স্বীকার করতেই হয় যে ছবিটি দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। এ ছবির নিচে এর আগে যে দেয়ালচিত্র ছিল, তাতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় নামক যন্ত্রে প্রবেশ করে ‘সহমত ভাই’ বলতে উচ্চকিত একটি যান্ত্রিক শ্রেণিতে পরিণত হয়।
এর আগে এখানে ছিল ২০১৭ সালে অপর এক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের কাঁঠাল ও গাছের ডাল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগের এক ব্যাঙ্গাত্মক দেয়ালচিত্র। দেয়ালটির ওপরের অংশে ছিল ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হওয়া জুবায়ের আহমেদের হত্যাকারীদের বিচারের দাবির দেয়ালচিত্র নিহতের ছবিসমেত।
অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে উদ্ভূত নতুন বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো সর্বদাই নতুনরূপে সামনে এসেছে, আবার নতুন কোনো দাবির মুখে পরিবর্তিতও হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর যে দৃষ্টিনন্দন দেয়ালচিত্রটি রয়েছে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম প্রয়োজনেও বঙ্গবন্ধুর অবমাননার অভিযোগের দায় ছাড়া কি সেখানে অন্য কিছু করা যাবে?
উত্তরটি হলো– যাবে না। যাবে না, কারণ এমনটি করা হলে কী পরিণতি হতে পারে সেটিও এখন আমাদের সামনে একেবারে স্পষ্ট। রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে প্রাসঙ্গিকতা না হারানো দেয়াললিখন বা দেয়ালচিত্রের ওপর নতুন করে দেয়ালচিত্র এঁকে দেওয়া বা দেয়াললিখনের ভেতর বিষয়টি আর সীমাবদ্ধ নেই। যদিও এরই মধ্যে আলোচ্য দেয়ালটিতে ফের বঙ্গবন্ধুর একটি দেয়ালচিত্র আঁকা হয়েছে।
কিন্তু সেই দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর আগের চিত্রটি মুছে নতুন দেয়ালচিত্র অঙ্কনের অপরাধে ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের একাংশের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এই দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি মুছে নতুন দেয়ালচিত্র অঙ্কনের বিষয়টি নিয়ে অনেক বয়ান-প্রতিবয়ান-ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি হওয়ার বিষয়টিকে কিংবা এর ফলে চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের লাভ-ক্ষতির হিসাবকে এক পাশে রেখে এটি এখন স্পষ্ট করেই বলা যায়, ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলোতে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর ছবি, তর্জনী বা উক্তি ব্যবহারের বিষয়টি আশঙ্কা থেকে বাস্তবে পরিণত হলো।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও প্রতিবাদ করেছিলেন, রাজপথে নেমেছিলেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি নান্দনিক ভাস্কর্য স্থাপনের আলোচনাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে আলোচিত হয়েছিল।
কিন্তু সেটি বাস্তবে পরিণত হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্রটি মুছে ফেলার বিষয়টিকে শিক্ষকদের একটি অংশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(ক) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি হিসেবে দেখানোর চেষ্টাও করা হয়েছে, সরল বিশ্বাসে করা হলেও এই চেষ্টাকে সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদের ভুল ব্যাখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। অথচ ড্রেনের ঠিক ওপরে, ছাত্রদের শৌচাগারের ঠিক পাশের একটি দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর দেয়ালচিত্র আঁকা শোভনীয় হয় কিনা– একবারের জন্যও আমরা তা ভাবার প্রয়োজন মনে করিনি। তাহলে কি নিজেদের স্বার্থরক্ষায় বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহারের প্রশ্নটিকে একেবারে বাতিল করা যায়?
এই যে নিজ স্বার্থরক্ষায় ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে একটি সস্তা মাধ্যমে পরিণত করার প্রচেষ্টা, দ্ব্যর্থহীন চিত্তে তার বিরোধিতা করা প্রয়োজন। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ চট্টগ্রামে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আমার শক্তির উৎস।’ কিন্তু যাদের নানাবিধ হীনকর্মের ফলে বঙ্গবন্ধুকে আজ একটু একটু করে তাঁর শক্তির উৎস তথা দেশের সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর জন্যই আহমদ ছফা তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর একেবারে শুরুতেই লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।
এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ আর এরূপ স্বার্থান্বেষী মহলের দাপুটে উপস্থিতির বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর ক্ষুদ্র ভক্ত হিসেবে বলার থাকে সেই পুরোনো বুলিই, ‘যেই মুজিব জনতার, সেই মুজিব মরে নাই। যেই মুজিব জনতার, সেই মুজিব মরে না।’
শিবলী নোমান: শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়