ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

মাছের মায়ের পুত্রশোক

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা

মাছের মায়ের পুত্রশোক

মারুফ বরকত

মারুফ বরকত

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ০৫:০২ | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪ | ১১:০৯

সমুদ্র অসীম হলেও সেখানে মাছের সংখ্যা এখন আর অসীম নয়। কমার্শিয়াল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিংয়ের চাপে অসীম সমুদ্রের মাছও উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। বছরে সমুদ্র থেকে মাছ ধরা হয় প্রায় ১৭৮ মিলিয়ন টন (এফএও, ২০২০)। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটি ধরলে জনপ্রতি বছরে প্রায় সোয়া ২২ কেজি মাছ সমুদ্র থেকে ধরা হয়।

আমরা চারজনের পরিবার হিসাবে তাহলে বছরে ভাগে পাই ৮৯ কেজি সামুদ্রিক মাছ। এর থেকে সাকল্যে ১০ কেজি সামুদ্রিক মাছও বছরে খাই কিনা, ভেবে দেখতে হবে। ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাইছি মূলত ১৭৮ মিলিয়ন টন বিষয়টা কী– বোঝার জন্য। সমুদ্রে কত মাছ আছে, তার হিসাব কেউ জানে না। তবে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তা দেখে পরিবেশবাদীরা উদ্বিগ্ন।

জাতিসংঘ ২০১৫ সালে যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ঘোষণা করে, সেখানে ১৪.৬ নম্বর লক্ষ্য হলো সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য সম্পদ সংরক্ষণ। সামুদ্রিক মাছের বৃহৎ কারবার দেখে এই কারবারিদের মোড়ল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে ধরে বসল জাতিসংঘ– সমুদ্রে অতি মৎস্য আহরণ উৎসাহিত করে এমন ধরনের সরকারি সহায়তা বন্ধ করার ব্যাপারে বিধান বানাতে হবে। কিন্তু বাণিজ্যের বিধান মুনাফা ছাড়া কখনও মানুষ বা পরিবেশ সম্পর্কে ভাবতে পারে না। সুতরাং তারা ভাবতে বসল, এমন কোনো বিধান বানানো যায় কিনা, যা দিয়ে লাঠি ভাঙবে কিন্তু সাপ মরবে না। ঠিক করা হলো, উন্নয়নশীল যেসব দেশ বেশি মাছ ধরে তাদের নিরুৎসাহিত করতে হবে। যেমন– ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ। 

বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ জেলে নানাভাবে মাছের কারবারে জড়িত। এর মধ্যে সমুদ্রগামী জেলের সংখ্যা ২০ শতাংশেরও কম। তার মধ্যে বেশির ভাগই জেলে শ্রমিক। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার নিবন্ধিত কাঠের নৌকার সংখ্যা মাত্র ১২ হাজার, অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরার নৌকা প্রায় ৬০ হাজার। সমুদ্রে মাছ ধরায় নিয়োজিত বেশির ভাগ মানুষ মৎস্য শ্রমিক। তাদের মধ্যে অনেকেই ঋণগ্রস্ত, আগাম শ্রম বেচা মানুষ। অনেকটা ক্রীতদাসের মতো। 

ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশের চিত্র একই রকম; কমার্শিয়াল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিংয়ের বদলে ব্যক্তি উদ্যোগে জীবিকার জন্য মাছ ধরার লোকের সংখ্যা বেশি। একে আর্টিজানাল ফিশিং বলা হয়। এদের থেকে যারা কিছুটা বড়, তাদের স্মল-স্কেল ফিশার বলে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিংয়ের যে আকার, তার তুলনায় বাংলাদেশের ব্যক্তি পর্যায়ের সবচেয়ে বড় সমুদ্রগামী মাছ ধরার নৌকাও স্মল-স্কেল। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিংয়ে নিয়োজিত একটা ফিশিং বোট একবারে ১০ হাজার টন মাছ ধরার ক্ষমতা রাখে। সেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নৌকাটিও ১০ টন মাছ ধরার ক্ষমতা রাখে না।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিংয়ে এগিয়ে থাকা দেশ আমেরিকা, চীন, নরওয়ে ইত্যাদি মাছ ধরার নৌবহরকে উচ্চমাত্রার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। তার মধ্যে আছে জ্বালানি তেল, বীমা, সহজ শর্তে ঋণ ও নানা ধরনের প্রণোদনা। কর্তৃত্ব ও একচেটিয়া বাণিজ্য বজায় রাখতে তারা এসব প্রণোদনা ও ভর্তুকি দেয়।

নিজেদের ভর্তুকি বন্ধ না করে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য তারা কিছু বুদ্ধি এঁটেছে। তার মধ্যে আছে যারা পৃথিবীর মোট সামুদ্রিক মাছ আহরণের (যেমন ১৭৮ মিলিয়ন টন) শূন্য দশমিক ৮ শতাংশের বেশি মাছ ধরবে, তারা আর ভর্তুকি দিতে পারবে না। পাশাপাশি তাদের সমুদ্রসীমায় মাছ ও অন্যান্য সম্পদের বছরওয়ারি হিসাব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে দাখিল করতে হবে। যেসব দেশের নৌকা উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইলের (২৩ কিলোমিটার) বেশি দূরে মাছ ধরতে যায়, তারা ভর্তুকি দিতে পারবে না। যাদের নৌবহরে ২৪ মিটারের চেয়ে বেশি লম্বা নৌকা আছে, তারা ভর্তুকি দিতে পারবে না। এ রকম আরও ডজনখানেক নিয়ম তারা বানিয়েছে। বাংলাদেশ যদিও এখন স্বল্পোন্নত দেশ, এসব নিয়ম বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পা দেওয়ার পর তিন বছর তারা একটা গ্রেস পিরিয়ড পাবে। তার পর থেকে এসব নিয়ম তাদের মেনে চলতে হবে।

এসব নিয়মের মধ্যে কিছু ফাঁকি আছে। স্বল্পোন্নত তো বটেই, উন্নয়নশীল অনেক দেশেরই তাদের সমুদ্রসীমায় মৎস্য ও অন্যান্য সম্পদ পরিমাপ করার মতো সক্ষমতা নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে তারা কীভাবে রিপোর্ট করবে? ১২ নটিক্যাল মাইলের বাইরে গিয়ে মাছ ধরলে আর স্মল-স্কেল জেলে হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। অথচ ইন্ডাস্ট্রিয়াল দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বাংলাদেশ, ভারতসহ অনেক দেশেরই ১২ নটিক্যাল জলসীমায় আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। ক্ষুদ্র জেলেরা তাদের ছোট নৌকা নিয়েই বহুদূর পাড়ি দেয় মাঝ ধরার জন্য।

বাংলাদেশে মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত একটা বড় অংশ মৎস্য শ্রমিক। ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশেই এসব শ্রমিক অভাবের তাড়নায় আগাম টাকা নিয়ে বছরের শ্রম বিক্রি করে রাখে। ফলে তারা নানা বঞ্চনার শিকার হয়। ঠিকমতো তাদের বেতন-ভাতা হিসাব করা হয় না। মাছের বড় কারবারি দেশগুলো এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। বলছে, এভাবে যারা মানবাধিকার হরণ করছে, তাদেরও মাছ ধরা কমাতে হবে অথবা মাছ ধরায় ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

আলাপটা ছিল, অসীম সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে অতি মৎস্য আহরণ বা ওভারফিশিংকে নিরুৎসাহিত করতে ভর্তুকি কমাতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে, অতি মৎস্য আহরণ, অতি সক্ষমতা হ্রাসে এবং অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত ও হিসাববিহীন মৎস্য আহরণ বন্ধ করতে হবে। যারা কাজটি করছে, তারা এখন কৌশলে সেই দায় চাপিয়ে দিচ্ছে বেশি জনসংখ্যাওয়ালা উন্নয়নশীল দেশের ঘাড়ে। কারণ এটা সত্য, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীর সংখ্যা যদি বেশি হয়, যেমন– ভারত, তাদের সম্মিলিত মাছ ধরার পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যায়। এখন তারা এসব উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র ও আর্টিজানাল জেলেদের কথা না ভেবে মাছের পরিমাণ নিয়ে ভাবছে। নিজেরা বিপুল আকারে ঐতিহাসিকভাবে মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করে আসছে, অথচ এখন মানুষ কীভাবে বাঁচবে তা না ভেবে মাছের শোকে কান্নাকাটি করছে। কারণ, দিন শেষে মুনাফাই তাদের কাছে বিবেচ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা মানুষ ও জীবন বোঝে না; শুধু বাণিজ্য বোঝে। মাছের মায়ের পুত্রশোক তাই তাদেরই।

মারুফ বরকত: পরিচালক-পার্টনারশিপ ও উন্নয়ন যোগাযোগ, কোস্ট ফাউন্ডেশন

আরও পড়ুন

×