মিয়ানমার বিষয়ে আসিয়ান উদ্যোগ গতি পাচ্ছে
প্রতিবেশী

.
উইলিয়াম জোনস
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৪ | ০০:২৪
মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী যুদ্ধে ২০২৩ সালে কয়েকটি সশস্ত্র নৃগোষ্ঠীর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বা তিন ভ্রাতৃজোট শান প্রদেশে, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি উত্তর-পূর্বে এবং কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন দক্ষিণে সফলতা পেয়েছিল। সম্প্রতি আরাকান আর্মি পশ্চিমাঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী টাটমাডোকে পরাজিত করেছে এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকশ সদস্য ভারত-বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এ জান্তাবিরোধী লড়াইয়ের বিস্তার ও যুদ্ধক্ষেত্রের সাফল্য পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের অনেক সদস্যকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। মিয়ানমারের পশ্চিমে চলমান সংঘাতে উদ্বিগ্ন হয়ে ভারত তাদের সীমান্ত এলাকায় আবারও শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে এবং দেশটিতে পালিয়ে আসা টাটমাডো সেনাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে।
বেশ আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, ব্যাংককও এ বিষয়ে নীতিগত পরিবর্তন এনেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সামরিক নেতা প্রায়ুত চান-ওচার নেতৃত্বাধীন সরকারে থাইল্যান্ড আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ‘দুষ্ট রাষ্ট্র’ বলে গণ্য হতো। তখন ব্যাংকক মিয়ানমার বিষয়ে আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্য কার্যকরে নিছক মুখে মুখে সম্মতি দিয়েছিল। একই সঙ্গে তারা মিয়ানমারের যুদ্ধবিমানকে বিদ্রোহীদের ওপর বোমা ফেলতে আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি প্রদান এবং মিন অং হ্লেইং ও তার সামরিক সরকারকে খোলাখুলি সমর্থন দিয়েছিল।
বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে ২০২৪ সালেই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতা একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। লুয়াং প্রাবাংয়ে অনুষ্ঠিত আসিয়ান মন্ত্রীদের সম্মেলনে দেশটির সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলোই তার প্রমাণ বহন করছে, যেখানে মিয়ানমার আসিয়ানকে তাদের সঙ্গে ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করার অনুরোধ জানিয়েছে। আসিয়ান মন্ত্রীদের এই বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধি ছিলেন মার্লার থান হাইক, যিনি মিয়ানমারের হয়ে আসিয়ানের স্থায়ী সেক্রেটারি হিসেবে আছেন। ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর এই প্রথম দেশটি আসিয়ানের শীর্ষস্থানীয় কোনো সভায় তাদের একজন অরাজনৈতিক প্রতিনিধি পাঠিয়েছে।
আসিয়ান এখন মিয়ানমার বিষয়ে এমন একজন বিশেষ দূত পেয়েছে, যিনি একজন পাকা কূটনীতিকই নন শুধু, একই সঙ্গে বহু গুণেরও অধিকারী। আলউঙ্কিও কিত্তিখুন নামে এ কূটনীতিক বিশেষত কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, লাওস ও ভিয়েতনামের সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন, দেশগুলোর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘাত-সমন্বয়ের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ধারণা রাখেন। তিনি এখন আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাজ করছেন, যাদের মধ্যে তার প্রতি সমর্থনের কোনো অভাব নেই। এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, ২০২২ সালে কম্বোডিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এ দায়িত্ব পালনের সময় বেশ ঝামেলায় পড়েছিলেন। কারণ তাঁর বিষয়ে মতৈক্য না থাকায় দেখা গেছে, আসিয়ান সদস্যদের একজন তাঁকে সমর্থন করলে অন্যজন প্রত্যাখ্যান করেছে।
ফলে হুনসেন যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন, আলউঙ্কিকে তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে না।
২০২৪ সালের মার্চে থাইল্যান্ড তাদের মিয়ানমার সীমান্তের মা সত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে। এখানে আনুমানিক ২০ হাজার অভাবী লোকের কাছে এ সহায়তা পৌঁছাবে। তবে এখানে বেশ কিছু উদ্বেগও রয়েছে। নৃগোষ্ঠীদের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সবই থাইল্যান্ড সীমান্তে মানবিক সহায়তাকে সমর্থন দিচ্ছে না। এটি থাইল্যান্ডের পদক্ষেপে ফাটলের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে থাই সেনারা বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব খাটাতে সক্ষম হয়নি। এদিকে ব্যাংকক জোর দিয়ে বলছে, মানবিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং তা অরাজনৈতিক পদ্ধতিতে ভাগ করে। যদিও অভ্যন্তরীণ বেসামরিক সংঘাতের বেলায় এ ধরনের ঘটনা খুবই দুর্লভ।
মিয়ানমারের প্রতিবেশীদের মনোভাবের এই পরিবর্তন নেপিদোর জেনারেলদের জন্য ভালো কিছু নয়। ইতোমধ্যে নেপিদো আন্তর্জাতিক পরিসরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে তারা আঞ্চলিক মিত্র ও নিকট প্রতিবেশীদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে। এগুলো ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাপের সঙ্গে মিলিত হয়ে মিয়ানমার ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসছে। এর মানে অবশ্য এই নয়, শান্তির সহজ পথ মিলে গেছে। তবে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডিগুলোর প্রতি আসিয়ানের চোখ বন্ধ রাখার মনোভাব কমে আসছে।
২০২৪ সালে মিয়ানমারে অস্থিরতা বেড়ে গেলে আসিয়ানকেই আঞ্চলিক নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ আসিয়ানই এ অঞ্চলের অংশীদারদের সমন্বয় করার আসল শক্তি। এখানে রয়েছে আসিয়ান রাষ্ট্রগুলো, চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র।
এ দেশগুলো অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও মানবিক সহায়তার শক্তিশালী উৎসের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা সংঘাতকে কমিয়ে আনতে এবং যুদ্ধরত সব পক্ষকে শত্রুতা ভুলতে কোনো না কোনোভাবে চাপ দিতে পারে।
থাইল্যান্ড পুনরায় মূলধারায় যোগ দিয়েছে এবং আসিয়ানকে অবমূল্যায়ন করা বন্ধ করছে। এর মধ্য দিয়ে আসিয়ানের আদি পাঁচ সদস্য মিয়ানমার বিষয়ে নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে আনছে এবং এ বিষয়ে ঐকমত্যের একটা সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছে।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে মিলঝিল রক্ষার বিষয়টি ছিল আসিয়ানের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার সেই ভাবমূর্তি এখন বিপর্যস্ত। তবে সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ ও বাইরের পরিবর্তনগুলো জোটটির বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে এনেছে বলে দেওয়া যায়। আশা করছি, আসিয়ান অবশেষে এমন ফলাফল তৈরি করতে পারবে, যাতে জোটের কঠিন সংকট চলে যাবে।
উইলিয়াম জে জোন্স: থাইল্যান্ডের মাহিডল ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সহকারী অধ্যাপক; ইস্ট এশিয়া ফোরাম থেকে অনুবাদ করেছেন ইফতেখারুল ইসলাম
- বিষয় :
- আসিয়ান