সাদি মহম্মদ প্রমাণ করলেন, তিনি ছিলেন
শ্রদ্ধাঞ্জলি

শিল্পী রহমান
শিল্পী রহমান
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪ | ০২:৪৫ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ | ১২:৩৪
১৯৭৮ সালে মোহাম্মদপুরের সলিম উল্লাহ্ রোডে শহীদ পরিবার হিসেবে একটি বাসা পাই আমরা। প্রথমেই প্রশ্ন জেগেছিল– মুঘল নামের ভিড়ে এই রাস্তাটার নাম কেন ‘সলিম উল্লাহ্ রোড’। তখনই জানলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর ‘অপরাধে’ সাদি মহম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদের বাবাকে অবাঙালিরা নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।
আমার বাবাকেও মর্মান্তিকভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। তাই একটা সংযোগ অনুভব করেছিলাম। যদিও ছোট ছিলাম, বুঝেছিলাম, সাদি মহম্মদরা আমাদের মতোই শহীদ পরিবার। একবার শহীদ পরিবার-সংক্রান্ত একটা কাজে মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম তাদের বাসায়। এর পর আরও কয়েকবার যাওয়া হয়েছিল। পুরো পরিবারই অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী। আমরা সবাই ছিলাম প্রজন্ম ’৭১-এর সদস্য।
আমি সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দেশে যাই। ১৫-২০ বছর আগের কথা, তখন টিভিতে প্রতিবছর ১৪ বা ১৬ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারের (প্রজন্ম ’৭১) সাক্ষাৎকার দেখানো হতো। আমার বড় বোন রিজিয়া রহমান অংশগ্রহণ করতেন সেখানে। একই অনুষ্ঠানে সাদি ভাইসহ অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। একবার এমনই একটি অনুষ্ঠানে তাঁর বাবার মৃত্যুর ঘটনা শুনে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমার। অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন। সাদি মহম্মদের বলার ধরন এমন ছিল যে, সারাদিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেই মর্মান্তিক বর্ণনা। এর আগ পর্যন্ত আমি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আমার বাবার ভয়াবহ মৃত্যুর স্মৃতি ধারণ করতাম। সেদিন সাদি মহম্মদের বাবার নির্মম মৃত্যু এবং তাঁর দৌড়ে পালিয়ে বাঁচার বর্ণনা আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। এর পর আমি যতবার সাদি ভাইয়ের কাছে তাঁর বাবার মৃত্যুর বর্ণনা শুনেছি, প্রতিবার তিনি তাঁর পালিয়ে বাঁচার ঘটনাকে ‘স্বার্থপরতা’ মনে করেছেন; নিজেকে অপরাধী ভেবেছেন। এই কথাটা বলার সময় তিনি উদাস হয়ে যেতেন। সেই থমথমে অবয়বের আড়ালে আমি যেন বুকফাটা কান্না দেখতে পেতাম। মনে হয়েছে, তিনি হয়তো কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি। এই ট্রমা তাঁকে আজীবন তাড়া করেছে বলেই বারবার বলতেন।
একজন মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেয় না। এই চিন্তা বহুবার কড়া নেড়েছে তাঁর মনে। হয়তো কাজকর্ম, কথা, গল্পে প্রকাশও করেছিলেন, কিন্তু বোঝা যায়নি। তাঁর ট্রমা যেহেতু ’৭১-এ শুরু হয়েছিল, তাই দুঃখগুলোকে হয়তো একই রকম মনে হতো। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অণিমা রায় বলেছেন, তাঁর সঙ্গে ১৫ দিন আগেই একটা শুটিংয়ে দেখা হয়েছিল; সেদিনও তিনি বাবার মৃত্যুর কথা বলেছিলেন; বলেছিলেন তাঁর অভিমানের কথা। এই অভিমানের কথা সংগীতজগতের সবাই মোটামুটি জানতেন। সাদি মহম্মদের ভাই শিবলী মোহাম্মদের সাক্ষাৎকারেও জানা গেছে অভিমানের কথা। তাহলে দেখা গেল, এই অভিমানের বিষয় অজানা কিছু নয়। সেই সঙ্গে পুরো দেশবাসী জানত তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ট্রমার কথা।
একটি সাক্ষাৎকারে দেখলাম, সাদি মহম্মদ বরাবরের মতো তাঁর বাবার মৃত্যুর বর্ণনা দিলেন, তারপর হুইলচেয়ারে বসা মায়ের মাথার ঘোমটা ঠিক করে দিলেন। বললেন, ‘আমাদের মা হচ্ছে আমাদের পৃথিবী।’ তিনি মায়ের সেবা করে গেছেন আজীবন; বিয়েও করেননি। মায়ের সঙ্গে কত মায়া, কত স্মৃতি! ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়া মা সেলাই করে কী করে আহার জোগাড় করতেন– এটা তাঁর কাছে ছিল বিস্ময়। সহজ জীবনের চেয়ে সংগ্রামী জীবনের স্মৃতি বেশি। মা চলে যাওয়ার পর একাও হয়ে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। রোজ যার খোঁজ নিতেন, পাশে থাকতেন, সেই মানুষও চলে গিয়েছিলেন। তা ছাড়া সেদিন বাবার পাশে থাকতে পারেননি বলে যে অপরাধবোধ তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে; এর পর মাকে অবলম্বন করেই বেঁচে ছিলেন তিনি। আজ অবলম্বনহীন জীবন হয়তো অর্থহীন মনে হয়েছে। একাকিত্বের বিষয়কেও হালকা করে দেখা যায় না– হঠাৎ কোনো দায়িত্ব নেই, কারও যত্ন নিতে হয় না। ফাঁকা জীবন।
তিনি তো অনেক মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, সেটা নিয়েই থাকতে পারলেন না কেন? এ প্রশ্ন অনেকেই করেছেন, দেখলাম। কিন্তু বুঝতে হবে, একজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ যেভাবে জীবন দেখতে পারে, একজন ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষ সেভাবে পারে না। এটাই পার্থক্য। একজন বন্ধু বা কাছের মানুষ দুঃখের কথা শুনবে, সান্ত্বনা দেবে। বলবে– ‘অভিমান করো না’ অথবা ‘মানুষের ভালোবাসা তো পেয়েছ; নাই বা পেলে জাতীয় স্বীকৃতি’। এসব কথা আসলে সাহায্য করে না; বরং ধীরে ধীরে তাঁর নিজের প্রত্যাশার প্রতি একটা অপরাধবোধ ও প্রশ্ন তৈরি করে। সেই ’৭১ থেকে ট্রমা বয়ে বেড়ানো এই অসাধারণ অমায়িক, বিনয়ী একজন মানুষ অন্যকে দিতে দিতেই একসময় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি হারিয়ে গেলেন ঘন অন্ধকারে।
চিকিৎসাধীন থাকলে এই বিরহ নেওয়ার শক্তি সঞ্চয় করতে পারতেন; পিতার মৃত্যুতে নিজেকে স্বার্থপর মনে না করে ক্ষমা করতে শিখতেন; নিজের জন্য সেই স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পারতেন কিংবা স্বীকৃতি না পেলেও কিছু যায় আসে না– সেই মনোভাব তৈরি করতে পারতেন। তা না করে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছেন ভেতরে।
সাদি মহম্মদ দীর্ঘদিন ধরেই মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। সবাই শুধু শুনেছে আর সান্ত্বনা দিয়েছে; প্রতিকারের চেষ্টা করেনি। ’৭১-এর ট্রমার একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে এখানে। একজন মানুষ মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে জীবনের উত্থান-পতন সামাল দিতে পারে।
আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সচেতনতা বাড়াতে হবে। একজন সাদি মহম্মদকে আমরা আর ফিরে পাব না। কিন্তু আর কাউকে যেন এভাবে না হারাতে হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
বি.দ্র. বিভিন্ন ঘটনা দেখে, সাদি মহম্মদের নিজের ও কাছের মানুষদের সাক্ষাৎকার শুনে এবং অভিজ্ঞতা থেকে একটা মানসিক পর্যালোচনা করা হলো। এ লেখা কাউকে আঘাত করলে আমি দুঃখিত।
শিল্পী রহমান: কাউন্সেলর, অস্ট্রেলিয়া
- বিষয় :
- সাদি মহম্মদ