ইসির ভুলের খেসারত নাগরিক কেন দেবে?
জাতীয় পরিচয় পত্র

আবু তাহের খান
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৫০
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) ৩ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি এনআইডির ক্ষেত্রে নানা ভুলভ্রান্তি ঘটিয়েছে বলে গত ৯ মার্চ খবর প্রকাশ করেছে আজকের পত্রিকা। এসব ভুলত্রুটির মধ্যে রয়েছে নামের অদল-বদল, নামের বানানে ভুল, জন্মতারিখ ভুল ইত্যাদি। ২০১৪ সালে জারিকৃত এ-সংক্রান্ত প্রবিধানমালা অনুযায়ী, এ ধরনের ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য ইসির কাছে আবেদন করার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। তবে, প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুক্তভোগীরা সে বিধান মেনে প্রতিকার চেয়ে ইসির কাছে আবেদন করলেও, আজ অবধি সেসব আবেদন ঝুলে আছে।
উল্লিখিত প্রবিধানমালায় এ ধরনের ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য নির্ধারিত ফি দিয়ে আবেদন করলে ইসির তা ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে অতিরিক্ত ফি দিয়ে আবেদন করলে তা ৭ দিনেই নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। আর এ পর্যায়ে ইসির সিদ্ধান্তে কোনো নাগরিক সন্তুষ্ট না হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৪৫ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ পাবেন, যা নিষ্পত্তির সময়সীমা হচ্ছে ৬০ দিন। অর্থাৎ উল্লিখিত প্রবিধানমালা অনুযায়ী আপিলসহ একটি আবেদন নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ সময়সীমা হচ্ছে ১৩৫ দিন। কিন্তু আবেদনের পর কয়েক বছর চলে গেলেও ইসি তা নিষ্পত্তি করতে পরেনি। অথচ উল্লিখিত সময়সীমা লঙ্ঘন করা বা এর ব্যত্যয় ঘটানোর কোনো অধিকার ইসির নেই। কোনো আইন ভাঙলে নাগরিককে যদি শাস্তি পেতে হয়, তাহলে অনুরূপ অপরাধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ওই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে না কেন?
সাধারণভাবে ইসির মূল দায়িত্ব হচ্ছে দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন আয়োজন। তো সেই আয়োজনের ব্যাপারে ইসির প্রতি দেশ-বিদেশের সাধারণ মানুষের আস্থায় যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, তার মূল কারণ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে না পারা। আলোচ্য ঘটনায় দেখা যায়, নির্বাচনবহির্ভূত কাজ সম্পাদনেও ইসির সামর্থ্য ও দক্ষতায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। আজকের পত্রিকার প্রতিবেদনের তথ্য জানাচ্ছে, উল্লিখিত আবেদনগুলোর মধ্যে এমনও রয়েছে, যা প্রায় পাঁচ বছর ধরে অনিষ্পন্ন। এ ধরনের নমুনা দেখে নির্বাচন কমিশনের ওপর দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা যদি আরও এক দফা হ্রাস পায়, তাহলে তার দায় ইসি ভিন্ন আর কার হতে পারে?
এনআইডি সংশোধন-সংক্রান্ত ইসির ২০১৪ সালের প্রবিধানে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি আদায়ের বিষয় শুধু অযৌক্তিক নয়; একই সঙ্গে যে কোনো নীতিনৈতিকতার পরিপন্থি। কারণ যে ভুল ইসির অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে ঘটেছে, তা সংশোধনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কেন ফি দেবেন? আইনের মৌলিক ভাষ্য বলে, এ ধরনের ভুলের জন্য ইসিরই উচিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। কিন্তু সেটি না করে উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকেই বাধ্য করা হচ্ছে ইসিকে ফি দিতে এবং ইসি ইতোমধ্যে তাদের কাছ থেকে এ বাবদ কয়েক কোটি টাকা আদায়ও করে নিয়েছে।
এ বিষয়ে শিগগিরই কেউ আইনের শরণাপন্ন না হলে সামনের দিনগুলোতেও এ ধারা একইভাবে অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা চলে। তাই উল্লিখিত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কারও না কারও উচিত হবে এ বিষয়ে অবিলম্বে আইনের আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস ও সামর্থ্য কি সাধারণ জনগণের রয়েছে? থাকলে তো বছরের পর বছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ আবেদন এভাবে অনিষ্পন্ন অবস্থায় ইসিতে পড়ে থাকত না! সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে বলে মনে করি, যাতে উল্লিখিত ফি প্রত্যাহার এবং একই সঙ্গে অনিষ্পন্ন আবেদনগুলোর নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত হয়।
এত বিপুলসংখ্যক আবেদন এভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেছেন, ‘সংশোধনের আবেদন করলে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তা নিষ্পন্ন করতে হয়। তবে এটি এত সময় কেন লাগবে, সে প্রশ্ন তিনি নিজেও রাখেন’ (আজকের পত্রিকা, ৯ মার্চ ২০২৪)। ইসি সচিবের জবাব শুনে মনে হচ্ছে, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও তিনি নিজে সে সম্পর্কে অবহিত নন। এ থেকেও বোঝা যায় প্রতিষ্ঠানটির হাল।
ইসি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এরূপ প্রতিষ্ঠানের হাতে যখন দেশের লাখ লাখ নাগরিক সেবা নিতে গিয়ে চরম ভোগান্তি ও সীমাহীন হয়রানির শিকার হন, তখন বিষয়টি কেমন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে না? বিষয়টির প্রতি আমরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) আশু দৃষ্টি আকর্ষণ ও হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এ প্রসঙ্গে শেষ বাক্যে বলাটা বোধ করি প্রাসঙ্গিক হবে, ইসির হয়রানির শিকার হয়ে যথাসময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র না পাওয়ার কারণে ওই মানুষদের মধ্যকার বহুজনের পাসপোর্ট আটকে আছে; বিদেশের চাকরিটি বাতিল হয়েছে; দেশের চাকরির আবেদনের সময়সীমা পেরিয়ে গেছে; বিদেশি বৃত্তির আবেদন করাই যায়নি; আত্মীয়ের পাঠানো রেমিট্যান্স ব্যাংক থেকে ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না; শ্রমিকের চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার অর্থ জোগাড়ের জন্য জমি বিক্রি স্থগিত হয়ে আছে ইত্যাদি। ইসির মনে রাখা দরকার, এসবের অনিবার্য নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপরেও পড়ছে।
আবু তাহের খান: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
- বিষয় :
- জাতীয় পরিচয়পত্র