ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

স্মরণ

এক স্যান্ডউইচ ভাগাভাগি করার ‘গাফ্ফার ভাই’

এক স্যান্ডউইচ ভাগাভাগি করার ‘গাফ্ফার ভাই’

মুনতাসীর মামুন

মুনতাসীর মামুন

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪ | ০০:০৭ | আপডেট: ২০ মে ২০২৪ | ০০:০৮

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে আমার সমসাময়িকরা সম্বোধন করতেন ‘গাফ্‌ফার ভাই’। তাঁর সমসাময়িকরা ছাড়া এটিই ছিল সর্বজনীন সম্বোধন। ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকেই পরিচয়; কিন্তু তা বলার মতো কিছু নয়। সাংবাদিক বা লেখকদের এমন অনেকে পরিচিত থাকেন। স্বাধীনতার পরপর আমার বড় চাচা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেন। পঞ্চাশের দশক থেকেই তাঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

১৯৭২ সালের পর আমার বন্ধু শাহরিয়ার কবির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি নানা পত্রিকায় কাজ করতেন। রহস্য পত্রিকা, সমীপেষু, ললনা; পরে বিচিত্রায় থিতু হন। এসব পত্রিকায় তিনি আমাকেও সংশ্লিষ্ট করে নিতেন। যদ্দুর মনে পড়ে, সমীপেষু বা রহস্য পত্রিকায় গাফ্ফার ভাইয়ের নতুন এক উপন্যাস ছাপা শুরু করেন শাহরিয়ার। বহুদিন পর লেখা উপন্যাসটি সবারই ভালো লাগছিল। তারপর হয়তো তিনি লেখা বন্ধ করে দেন অথবা পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে সূত্রেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হতো।

গাফ্‌ফার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় লন্ডনে, ১৯৭৯ সালে। প্রথম লন্ডন গেছি। সঙ্গে তাঁর ঠিকানা। বিদেশে একা, দেশি কাউকে পেলে আদর-অ্যাপায়নের মাত্রা বেড়ে যেত। প্রথম দিন এক রেস্তোরাঁয় বসি। দেখা গেল, দু’জনের কাছে থাকা অর্থ দিয়ে দু’কাপ চা চলে, কিন্তু দুটি স্যান্ডউইচ হয় না। একটি স্যান্ডউইচ নিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম। একে একে সবার খোঁজ নিয়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, বাংলাদেশের পরিবেশ, রাজনীতি, বন্ধু-বান্ধবকে তিনি মিস করছেন। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ন ছিল তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সে সময় কোনো কোনো আড্ডায় তিনি বলতেন, ‘এই ছোকরাটাকে দেখ, আমি তাঁর বাবার সঙ্গে কাজ করেছি। আর সে কিনা আমাকে চাচা না বলে, বলে ভাই।’ তারপর আকর্ণ বিস্তৃত হাসি।

হ্যাঁ, আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল, হয়তো কোলে-কাঁধেও নিয়েছেন। সে সূত্রে আমাকে অপার স্নেহ করতেন। যতবার লন্ডন গেছি বা দীর্ঘদিন থেকেছি, তাঁর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। তখন লেখালেখি করেই তাঁর যা উপার্জন। সামান্য। অর্থকষ্ট ছিল দারুণ। কখনও তা প্রকাশ করেননি। লন্ডনের বাঙালিদের যে কোনো সভায় তিনি ছিলেন মধ্যমণি। এখনও মনে পড়ে, প্রবল বৃষ্টি বা প্রবল ঠান্ডায় তিনি কোনো টিউব স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, তারপর কোনো আড্ডায় বা সভায় নিয়ে যেতেন। হয়তো আমার মধ্যে তিনি ঢাকার দিনগুলো খুঁজতেন। কখনও কখনও লন্ডনের আরেক প্রান্তে তাঁর বাসায় গেছি। হুইল চেয়ারে বসে তাঁর স্ত্রী চা বানিয়ে দিচ্ছেন, আমরা গল্প করছি। একবার পঞ্চাশ দশক নিয়ে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাঁর এত বড় পরিসরে আর কোনো সাক্ষাৎকার আছে কিনা জানি না।
পঞ্চাশ দশকের কথা বলছিলাম। আমাদের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনে পঞ্চাশ দশকের এই বুদ্ধিজীবীরা বড় প্রভাব রেখেছিলেন। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জহির রায়হান, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর– কত নাম বলব! উজ্জ্বল সব জ্যোতিষ্ক। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে এবং সমষ্টিগতভাবে আমাদের প্রভাবান্বিত করেছিলেন। বাংলাদেশে এমনটি আর হয়নি।

পঞ্চাশ দশকের আরও অনেকের মতো আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও গদ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কবিতাও লিখতেন সবার মতো। সংবাদ ভাষ্য তো ছিলই। সেই সময়কার গল্প-উপন্যাস পড়লে তাঁর শক্তিমত্ততার পরিচয় মেলে। কবিতায় ছিলেন দুর্বল। কিন্তু কী ভাগ্য, একটি কবিতাই তাঁকে অমর করে রেখেছে– ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। তাঁকে হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ‘পৃথিবীতে কেউ একটি কবিতা লিখে অমর হননি আপনি ছাড়া।’ যতদিন বাঙালি ও বাংলা ভাষা থাকবে, ততদিন গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এই একুশের গান গাওয়া হবে।
স্বাধীনতার পরপর গাফ্‌ফার চৌধুরীর পরিচয় হয়ে উঠল রাজনৈতিক ভাষ্যকার। পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হতে লাগল। তাঁর ভাষা পাঠকের সঙ্গে অনায়াসে যোগাযোগ করতে পারত। সমসাময়িক বিষয়ের চমৎকার বিশ্লেষণ করতেন। স্মৃতিচারণাও
যুক্ত হতো।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (১৯৩৪–২০২২)

বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্নেহ করতেন– এটি সুবিদিত। ফলে তাঁর বিভিন্ন ভাষ্য ও লেখায় বঙ্গবন্ধুর নানা প্রসঙ্গ এসেছে। এসব আমরা গবেষণামূলক প্রবন্ধে ব্যবহার করেছি। তিনি লিখেছেন, একবার বঙ্গবন্ধু তাঁর একটি লেখা নিয়ে ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু গাফ্ফার ভাইয়ের স্ত্রী যখন অসুস্থ, তখন এ বঙ্গবন্ধুই সপরিবারে তাঁকে লন্ডন যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন।

নব্বই দশকের পর থেকে আমিও ভাষ্য লিখতে শুরু করি গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তিনি লন্ডন থেকে ফোন করে বলতেন, ‘ভাতিজা, তুমি তো আমারে ডাউন দিলা। তোমার নাম সবাই কয়।’ ওই সময় এ বি এম মূসা, আবেদ খান, গাফ্ফার চৌধুরী, আমি প্রচুর ভাষ্য লিখেছি। গাফ্ফার ভাই আওয়ামী লীগের সমর্থক একনিষ্ঠভাবে। সমালোচনাও করতেন, যেটি আবার অনেকের পছন্দ ছিল না। তারা জানত না গাফ্ফার ভাইয়ের কী অধিকার ছিল সে সমালোচনার। তিনি অত্যধিক ভালোবাসতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে। রেহানাকে তো কন্যাসম দেখতেন।
আজ অনেকের মনে নেই, ১৯৯০-২০১০ পর্যন্ত ছিল সংবাদপত্রের ভাষ্য ও ভাষ্যকারদের স্বর্ণযুগ। আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে সংবাদপত্রে এসব লেখা তুমুল আলোচিত হতো। আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা উজ্জীবিত হতেন।

একটি ঘটনার কথা মনে আছে। কলকাতায় দৈনিক বাংলা স্টেটসম্যানের সম্পাদক মানস ঘোষের রুমে আমি ও গাফ্ফার ভাই বসে আছি। খবর এলো– শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হয়েছেন। আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু এরই মধ্যে মানস ঘোষ খাবার আনলেন। পরে একটি রুমে নিয়ে বললেন, ‘আপনারা দুজন এখানে কিবরিয়া সাহেবের ওপর দুটি লেখা দিয়ে যাবেন। আমি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি।’ চলে গেলেন তিনি। গাফ্ফার ভাই বললেন, ‘দেখ দেখি, খাইতে আইসা কী মুশকিলে পড়লাম!’

১৯ মে ছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর পুরো সংগ্রামই ছিল প্রগতির পক্ষে। আমাদের মননকে তিনি উজ্জীবিত করেছেন, ঋদ্ধ করেছেন। মাঝেমধ্যে মনে হয়, তিনি যদি সাংবাদিকতা ও সংবাদ ভাষ্য লেখায় ৫০টি বছর না দিতেন, তাহলে আমাদের সাহিত্য কত সমৃদ্ধ হতো! এ ধরনের মানুষ যে ক্ষেত্রেই কাজ করেন সে ক্ষেত্রেই উজ্জ্বল করে তোলেন। তাই এ ধরনের মানুষ চলে গেলে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সবাই বলেন, কোনো স্থান শূন্য থাকে না। ঠিক কিন্তু ও শূন্যতা পূরণ হয় না।   

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন: ইতিহাসবিদ ও লেখক    

আরও পড়ুন

×