স্মরণ
কাছ থেকে দেখা ভিন্ন সিরাজুল আলম খান

সিরাজুল আলম খান
ফারাহ খান
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪ | ০০:০৫
কারও আদর্শিক নেতা, কারও রাজনৈতিক গুরু, কারও মেন্টর, কারও পছন্দের পাত্র সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই। যার সান্নিধ্যে আমার শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠা; তিনি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা, আমার প্রাণের মেজো কাকা। আমি খুব কাছ থেকে পারিবারিকভাবে দেখা সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লিখছি। সেই সঙ্গে লিখছি– কেন, কীভাবে আমি সমাজ ও রাজনীতিতে জড়িয়েছি।
ছোটকাল থেকে বাসায় প্রায় সব সময়ই দেখেছি বড় বড় বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতার যাতায়াত। তখন থেকে রাজনীতিবিদ সিরাজুল আলম খানকে একটু একটু চিনেছি। আমার মনে আছে, ২০০৩-০৪ সাল থেকে একটু একটু করে মেজো কাকা আমার সঙ্গে রাজনৈতিক বিভিন্ন কথা বলা শুরু করেন। মেজো কাকার সঙ্গে আমি যখনই কোনো কথা বলতাম তিনি সেই বিষয়ে দু-এক মিনিট কথা বলেই রাজনীতির বিষয়ে টার্ন নিতেন। কোনো সময় ইতিহাসের সূত্র ধরে, কোনো সময় কারও বক্তব্যকে ঘিরে, কোনো সময় গল্পের ছলে শুরু করে দিতেন রাজনীতির কথা।
২০০৬ সালে আমি যখন প্রথম একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে থেকে কাজ শিখব চিন্তা করি, তখন তিনি বলেন, শুধু আইনজীবী হলে হবে না, আমাকে এমন আইনজীবীর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে যিনি আইন পেশার পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় এবং পরিচিত। তখন আমি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ স্যারের চেম্বারে যুক্ত হয়ে ২০০৭ সালে কেয়ারটেকার সরকারের সময় অনেক কাজ করেছি। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে রিসার্চার হিসেবে এবং ২০১২ সালে প্রসিকিউটর হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাজ করি। ২০১৩ সালে পারিবারিক কারণে আমি সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে স্থায়ীভাবে চলে আসি এবং এখানে লেবার পার্টির সঙ্গে রাজনীতি শুরু করি। কিন্তু ফোনে কথা বলার সময় কিংবা আমি দেশে গেলেই মেজো কাকা ৫-৭ মিনিট কথা বলেই আস্তে আস্তে অল্প অল্প করে আমাকে রাজনীতির কথা বলতেন। আমার কাছ থেকে ব্রিটিশ রাজনীতির গল্প খুব মন দিয়ে শোনার পাশাপাশি আমাকে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতেন। আমি খুব ভালো করে বুঝতাম তিনি আমাকে ‘জাসদীয়’ রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট করতে চাইতেন।
২০১৬ সালে তিনি আমাকে এক দিন মুখ খুলে বললেন আমি যেন দেশে এসে রাজনীতি করি। আমি কিছুটা নিমরাজি ছিলাম কিন্তু এর মাঝে ২০১৭-তে আমার কোল আলো করে প্রথম সন্তান এলো। আমি ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে আমার ছেলেকে নিয়ে যখন প্রথম দেশে গেলাম তখন ভাবলাম এবার হয়তো মেজো কাকার সুর পাল্টাবে। বললাম, মেজো কাকা, এখন আমার আর রাজনীতি করা সম্ভবই না। তিনি মৃদু হাসলেন। লম্বা কোনো উত্তর বা ব্যাখা না দিয়ে শুধু বললেন– ‘এখনও সম্ভব। তোকে দিয়ে সব সময়ই সম্ভব।’
দুই-তিন সপ্তাহ পর ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি এক দিন আমাকে ফোন করে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। আমি তাঁর বাসায় যাওয়ার আগে বুঝিনি সেই দিনটি আমার জীবনের বদলে যাওয়ার দিন। তিনি বললেন আমি যেন তাঁর রাজনীতি করি, আমি যেন ‘জাসদীয় রাজনীতি’ করি। তিনি বললেন, একশ্রেণির লোক বহু টাকার মালিক হয়েছে, তারা দেশের টাকার সম্পদ গড়েছে দেশের বাইরে। তুমি হবে ভিন্ন, তুমি বিদেশে তোমার উপার্জিত টাকা দেশে নিয়ে আসবে, তুমি সে মানুষগুলোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে যাদের আমি স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম। আমি যদিও রাজি হতে চাইনি প্রথমে কিন্তু তিনি আমাকে বুঝিয়েছেন। তিনি আমাকে আরও বলেছিলেন- ‘সবার আগে দেশ। তোমাকে জাসদীয় রাজনীতিতে দরকার। এভাবেই এ দেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লাম।
এভাবে লন্ডন ছেড়ে, আমার পেশা ফেলে, তিন বছর এবং ছয় বছরের দুটি ছোট্ট শিশু রেখে বাংলাদেশে অবস্থান করছি।
মেজো কাকা আমাকে বহু কিছু শিখিয়েছেন। আমি সব সময় তাঁকে দেখেছি এবং উপলব্ধি করেছি তিনি এই পুরো বাংলাদেশকেই নিজের ঘর নিজের সংসার মনে করতেন। তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেয়েছেন আমিও যেন এই পুরো বাংলাদেশটাকে আমার ঘর আমার সংসার মনে করে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারি এবং কাজ করতে পারি।
তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুর দুই বছর আগে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি ৮১তম জন্মদিনে তাঁর নামে একমাত্র সংগঠন সিরাজুল আলম খান ফাউন্ডেশন ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট গঠন করি। সিরাজুল আলম খান দাদা ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি ও প্রকৃত স্বাধীনতা। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানের রেখে যাওয়া আইন ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা ছিল তাঁর আরাধ্য। এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। বই ও পুস্তিকা লিখেছেন। এ কাজে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন।
ব্যারিস্টার ফারাহ খান: সিরাজুল আলম খানের ভ্রাতুষ্পুত্রী
- বিষয় :
- স্মরণ
- সিরাজুল আলম খান