ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

উচ্চারণের বিপরীতে

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ও ভয়ংকর লুকানো সত্য

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ও ভয়ংকর লুকানো সত্য

মাহবুব আজীজ

মাহবুব আজীজ

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪ | ২৩:৫৩ | আপডেট: ০৯ জুন ২০২৪ | ২৩:৫৩

গত ৩১ মে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমবাজার বন্ধ ঘোষণার পর আন্তঃদেশীয় ‘সিন্ডিকেট’ বা ‘চক্র’ সম্পর্কে নানাবিধ বিন্যাসের খবরাখবর আমরা পেয়েছি। ২০০৯ সালে প্রথম দফা বন্ধ হয়ে ২০১৬ সালের শেষার্ধে খোলার পর বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট গড়ে। দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আবার শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়। ২০২২ সালের আগস্টে আবারও চালু হলে গত চার বছরে সেখানে গেছেন চার লাখ বাংলাদেশি কর্মী। সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকায় মালয়েশিয়া পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে এজেন্টের জন্য মাথাপিছু ৫০ হাজার টাকা মুনাফাও ধরা ছিল। কিন্তু জনপ্রতি কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যে ছয় হাজার কোটি টাকা হাপিশ করে দিয়েছে ‘সিন্ডিকেট’!

২০২২ সালে শ্রমবাজার চালু হলে কর্মী পাঠানোর জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনের দায়িত্ব পায় মালয়েশিয়া। তাদের কাছে ১ হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কোনো নীতিমালা ছাড়াই তারা মাত্র ২৫টি এজেন্সিকে বেছে নেয়। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাওয়া এই ২৫ এজেন্সির চক্র ধাপে ধাপে ১০০-তে উত্তীর্ণ হয়। চক্রে নাম ঢোকাতে যেমন প্রচুর অর্থ দিতে হয়, আবার চক্রে ঢুকে গেলে এজেন্সিগুলো ‘গাছের পাতাটি না নাড়িয়ে’ কর্মীপিছু দেড় লাখ টাকা পকেটে পোরে। সব মিলিয়ে বেশ ‘দেব আর নেব’ পরিস্থিতি!

চক্র নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীর নাম নানা সময়ে জানা গেলেও সম্প্রতি তিনজন সংসদ সদস্য, একজন সংসদ সদস্যের পরিবার, আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের নামও এ তালিকায় দেখা যাচ্ছে।

সমকাল জানাচ্ছে, “মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেটে নাম লিখিয়ে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করেছে কয়েকজন এমপির রিক্রুটিং এজেন্সি। অন্য ব্যবসায়ীর ‘কেনা’ কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র অটো রোটেশনে আসে সিন্ডিকেটে থাকা রিক্রুটিং এজেন্সির নামে। তাদের মাধ্যমে ছাড়পত্র এবং ই-ভিসা করার বাধ্যবাধকতার সুযোগে এজেন্সিগুলো কর্মীপ্রতি লাখ দেড়েক টাকা নেয়।’ (৪ জুন ২০২৪)

বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা করার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নিয়মনীতি ছিল না। তাই কর্মী পাঠানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই মূল হোতাদের যোগসাজশে তালিকায় নাম লিখিয়েছেন কেউ কেউ। এরপর ঘরে বসে বসে টাকা আয় করেছেন। কর্মীপ্রতি ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা নিচ্ছে চক্রে থাকা এজেন্সি।’ (প্রথম আলো, ৩১ মে ২৪)

এর আগে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পদে পদে ঘুষ দিতে হয় বলে এক চিঠিতে অভিযোগ করেন জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞ। চিঠিতে বলা হয়, কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুই হয় দেশটির মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে। ২৮ মার্চের এই চিঠি জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস ২৬ মে প্রকাশ করে। ৬০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার জবাব দেয়নি বলেই চিঠিটি প্রকাশ করা হয়। এতে লেখা হয়, ‘মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীরা বিশ্বের সর্বোচ্চ নিয়োগ ফি প্রদান করেছেন, যা বাজারে প্রচলিত হারের চেয়ে অনেক বেশি।’

২.
জবাব না দেওয়ার দায়হীনতা এ দেশে নতুন নয়। তবে নিজের কাজে অতি তৎপরতার ক্ষেত্রে এ দেশের ক্ষমতাদর্পী রাজনীতিবিদদের জুড়ি মেলা ভার! মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের চার সংসদ সদস্যের নিজস্ব ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের যে বৃত্তান্ত আমরা জেনে উঠছি, তা বিস্ময়-জাগানিয়া!

চার সংসদ সদস্য– ১. মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ২. নিজাম উদ্দিন হাজারী, ৩. বেনজীর আহমদ ও তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং ৪. আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী ও কন্যা যথাক্রমে ৮,৫৯২ জন, ৭,৮৬৯ জন, ৭,৮৪৯ জন ও ৯,৮৬১ জন কর্মীর ছাড়পত্র প্রদান করে জনপ্রতি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন। তার মানে, যেখানে সরকার নির্ধারিত ফি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা, সেখানে জনপ্রতি পৌনে চার লাখ টাকা বেশি নিয়েছেন আমাদের এমপি ও এমপির স্বজনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।
কীভাবে সম্ভব এই তুঘলকি কাণ্ড? কোথাও কোনো রক্ষাকবচ নেই? যে যার খুশিমতো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাথাপিছু লাখ লাখ টাকা ঘরে তুলে নেবে? প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী অবশ্য নির্বিকার বলেছেন, ‘নিয়োগকারী দেশ চায় বলেই সিন্ডিকেট হয়েছে।’ সিন্ডিকেটে এমপির প্রতিষ্ঠান থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি রিক্রুটিং এজেন্সি। এর মালিক-এমপি চিনি না। তদন্তে দায়ী হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ (সমকাল, ৪ জুন ২০২৪)

মাননীয় মন্ত্রী, বালুতে মুখ গুঁজে থাকলে প্রলয় বন্ধ থাকবে? আপনি দায়িত্বশীল পদে আছেন, আপনার কর্মপরিধিতে এত বড় দুর্নীতি-অনিয়ম, আপনি জানবেন না কেন? যারা দেশের সাধারণ মানুষকে পথে বসিয়ে দেয়, তাদের বৃত্তান্ত অধরা থাকার কথা নয়, যদি তারা একই বলয়ের অংশ না হয়! এই বলয়ের নাম ক্ষমতা-কাঠামো!

৩.
আর সেইসব মানুষ? সর্বস্বহারা, নিঃস্ব মুখগুলো?

যারা ভিটেমাটি বেচে উপার্জনের আকাঙ্ক্ষায় প্রবাসী হতে চাইলেন! শেষ মুহূর্তে বিমানে উঠতে ব্যর্থ হয়ে বিমানবন্দরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন, তাদের কান্নার অনুবাদ কি আমরা শুনতে পাই? কেউ ধার করে, কেউ গরু-বসতবাড়ি, সামান্য জমি বিক্রি করে, কেউ ছোট দোকানটি তিল তিল গুছিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা এজেন্টের হাতে তুলে আশায় বসে ছিলেন। বিদেশ যাবেন, দিন ফিরবে। না, কিছুই না। ভিসা-ছাড়পত্র সব আছে, যাওয়ার মতো বিমানের বন্দোবস্ত নেই; তারা যেতে পারলেন না!
এই চরম অব্যবস্থাপনার দায় নেওয়ারও কেউ নেই। সব প্রশ্নের উত্তর একই– কমিটি তদন্ত করে দেখবে! কিন্তু সেই দেখা কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। ভুয়া কাজের প্রলোভনে, দালালের খপ্পরে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় অমানবিক জীবনযাপন করছেন। ১৭ হাজারের বেশি শ্রমিক ভিসা নিয়েও যেতে পারলেন না।

বাংলাদেশসহ আরও ১৫টি দেশের শ্রমিক মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যান। আর কোনো দেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও শৃঙ্খলা থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথাই নয়। খেটে খাওয়া মানুষগুলো বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতেই দেশ ছেড়ে মূলত মালয়েশিয়ায় যেতে চান। আমাদের সরকার রেমিট্যান্সের প্রশ্নে যত মুখর ও আনন্দিত, প্রান্তিক বা নিম্নবিত্ত মানুষের কর্মসংস্থান প্রশ্নে ততই নীরব। কারণ, নিজ দেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে উদ্ভাবনী সৃজনশীলতার প্রয়োজন; প্রয়োজন পরিকল্পনা, চিন্তা, শ্রম ও সততা; প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আনতে হয় জবাবদিহির আওতায়। সেসব ভুলে মাথাপিছু পৌনে চার লাখ টাকা ‘আয়ে’র সুখানন্দে ভেসে যাওয়ার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত বুঝিয়ে দেয়– সমাজের লুকানো সত্যগুলো ভয়ংকর অমানবিক।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
[email protected]

আরও পড়ুন

×