জনস্বাস্থ্য
অনিরাপদ খাদ্য যখন অব্যর্থ মারণাস্ত্র

প্রতীকী ছবি
ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৪ | ০০:১৩
মানুষ দীর্ঘদিন দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও পৃথিবীর অনেক প্রান্তে লাখ লাখ মানুষ খাবারের সুষ্ঠু বণ্টনের অভাবে না খেয়ে মরছে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারে পৃথিবীতে খাদ্য ঘাটতি অনেক কমে গেছে। বিভিন্ন যন্ত্রের সহযোগিতায় প্রতি সেকেন্ডে টন টন খাবার উৎপাদিত হচ্ছে। তা ছাড়া অতীতের তুলনায় খাবারে দেখা দিয়েছে বৈচিত্র্য। যতই খাবারের মাত্রা বাড়ছে, ততই বাড়ছে স্বাস্থ্যকর খাবারের সংকট। গতকাল সোমবার সমকাল ঢাকার আশপাশের ৬টি খাবার পরীক্ষা করে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। চটপটি, ছোলা-মুড়ি, স্যান্ডউইচ, আখের রস, অ্যালোভেরার শরবত ও মিক্সড সালাদে ই-কোলাই ও সালমোনেলা নামের উচ্চ মাত্রায় ডায়রিয়ার জীবাণু খুঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। শুধু ছোলা-মুড়ি কেন, পানির মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় পানীয়ও এখন নিরাপদ নয়। অথচ বাংলাদেশের নদীমাতৃক দেশ বলেই সুনাম রয়েছে। বর্তমানে আমাদের চারপাশে এমন কোনো কিছু নেই বললেই চলে, যেগুলো আমরা নিরাপদ বলতে পারি। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রতিমুহূর্তে অক্সিজেন প্রয়োজন। সেই অক্সিজেনও এখন নিরাপদ নয়।
বর্তমানে বাজারে ফলমূল থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যে এখন কেমিক্যাল ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে মানবদেহে প্রবেশ করছে বিভিন্ন জীবাণু। মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার গ্রহণের কারণে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজিন ব্যাকটেরিয়া; আধা সেদ্ধ কিংবা অপাস্তুরিকৃত দুধ খাওয়ার কারণে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করছে; কিংবা খাবারে দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে শিগেলা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। কিছু কিছু দোকানে সকালে রান্না করা খাবার পুরো দিন বিক্রি করা হয়। এতে ক্লোসট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেন ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বমি ও ডায়রিয়ার ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
একদিকে রোগব্যাধি যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে অনিরাপদ খাদ্যদ্রব্যের সমাহার। নগরায়ণ ও উন্নয়নের নামে আমরা গ্রাম-গঞ্জে সব জায়গায় গাছপালা উজাড় করছি, নদীনালা দখল করছি। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আগের মতোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এখন আর খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। নানা রকম রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদিত হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য। হাঁস-মুরগি, গরুসহ অন্যান্য গবাদি পশুর খাদ্যে ব্যবহার হচ্ছে অনিরাপদ ওষুধ। এগুলো ভক্ষণ করে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী সহজেই রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দিন দিন কমছে।
অন্যদিকে, পুরো দেশে সুনিয়ন্ত্রিত কোনো বাজার ব্যবস্থা নেই। চারপাশে ভয়াল সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রকমের বাজার। এসব ফুটপাতে নানা ধরনের পানীয় বিক্রি হচ্ছে। যেগুলোয় রয়েছে বিভিন্ন জীবাণু। অপরিষ্কার হাত, উৎপাদনযন্ত্র ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে সহজেই জীবাণু আক্রমণ করতে পারছে।
এ ছাড়া অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান অস্বাস্থ্যকর কারখানায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হলো, রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ নীতিনির্ধারক সবাই এই অরাজক অবস্থা নিয়ে অবগত। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোথাও কেউ নেই। ভোক্তা অধিদপ্তর বহুবার মোবাইল কোর্ট বসিয়ে এসব অসাধু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করলেও তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখনও দেখা যায়নি। বিচারহীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন সমস্যায় দেশ আজ সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এমন আবহে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার ঘটনা আশ্চর্যজনক কিছু বলে মনে হয় না। কারণ ন্যায়বিচারের ধারণাকে রাষ্ট্র ও নাগরিকরা অনেক সংকুচিত করে উপলব্ধি করছে। অথচ নিরাপদ খাদ্য পাওয়াও নাগরিক অধিকার। কিন্তু রাষ্ট্র যখন চারপাশের অসাধু কাজকারবারের ব্যাপারে জেনেও নীরব থাকে, তখন তা রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের সোচ্চার অবস্থানের অভাব রয়েছে। এ কারণে স্রেফ খাদ্যেই ভেজাল দেওয়া ঘটনা ঘটছে, এমন নয়। সমাজের প্রায় ক্ষেত্রে ঢুকে গেছে প্রতারণার জাল। খুব সহজেই আমরা এই বিপদ থেকে মুক্তি পাব না। নীতিনৈতিকতার সামষ্টিক বোধ ও ভিত তৈরি না হলে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র যদি ইনসাফের ধারণায় ‘নাগরিকদের নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার’কে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়।
বেঁচে থাকতে হলে প্রাণিকুলকে খাবার গ্রহণ করতেই হবে। তবে এ খাবার নিরাপদ না হলে মৃত্যুই ডেকে নিয়ে আসবে। যতদিন পুরো সমাজকে একটি চক্র হিসেবে উপলব্ধি করে আমরা দায়িত্বশীল আচরণ না করব, ততদিন এ সংকট ও সমস্যা থাকবে। তাই আমরা যেন জীবনের অর্থ আরও প্রসারিত করি। আমরা যেন চারপাশের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে জীবনের অর্থ খুঁজি। খাবারে ভেজাল দেওয়ার মানে আমরা আমাদেরকেই বিপন্ন করে তুলছি। ব্যবসায়ী, ছোট-বড় বিক্রেতা ও প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে এই বোধোদয় ঘটুক।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
[email protected]
- বিষয় :
- জনস্বাস্থ্য