উচ্চারণের বিপরীতে
সাদিক অ্যাগ্রো ও আলাদিনের চেরাগের ইতিবৃত্ত

মাহবুব আজীজ
মাহবুব আজীজ
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪ | ০০:৩২ | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪ | ০০:৩৩
বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা আর খাসির মাংসের কেজি ১১-১২শ টাকা। সাধারণ মানুষের পাতে যখন মাংসের টুকরো মেলা ভার; মলিন মুখে বাজারে বাজারে ঘোরা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে গরু বা খাসির মাংস; তখন কোরবানির ঈদে একটি ছাগল ১৫ লাখ টাকায় কিনতে গিয়ে সদ্য সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের পুত্র মুশফিকুর রহমান ইফাত অজানা সুড়ঙ্গের তালা খুলে দিয়েছে। কল্পনার যাবতীয় সীমা ছাড়িয়েছে তার পিতার সম্পদের পাহাড়। বছরের পর বছর অনিয়মের অলিগলিতে গড়ে তোলা সেই হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির বিবরণী কেউ জানতেই পারত না, যদি মতিউরের ‘পশুপ্রেমী’ পুত্রের ১৫ লাখি ছাগলের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল না হতো। এক ভিডিওতে ‘বেহুঁশ’ অনৈতিকতা ‘চিচিং ফাঁক’ হওয়ার পরই কেবল নড়েচড়ে বসে প্রশাসন যন্ত্র।
খোদ রাজধানীর হৃৎপিণ্ডে রামচন্দ্রপুর খাল দখল করে সাদিক অ্যাগ্রোর সুবিশাল খামার গড়ে উঠেছিল; সেখানে লাখ কোটি টাকা মূল্যের গরু, ছাগলের সুবিশাল মজুত তৈরি হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বছরের পর বছর সেখান থেকে নধরকান্তি পশু কিনেছেন; চোখ ধাঁধানো দামের কথা মহোৎসাহে ফেসবুকে-টেলিভিশনে উচ্চকণ্ঠে প্রচারও করে যাচ্ছিলেন সাদিক অ্যাগ্রোর কর্ণধার; কোটি টাকার গরু আর লাখ টাকার ছাগলের গল্প শুনে রূপকথার আবেশও পাচ্ছিল আমজনতা। কোথা থেকে ইফাতের ১৫ লাখি ছাগল দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে একের পর এক তিতে সত্য ফাঁস করে দিচ্ছে!
ছাগলের দাম নিয়ে জল অনেক ঘোলা হওয়ার পর সমকাল জানাচ্ছে, সিটি করপোরেশনের অভিযানের তৃতীয় দিন ‘রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ এলাকার সাদিক অ্যাগ্রোর পুরো খামার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’ (৩০ জুন ২০২৪)।
দেখা যাচ্ছে, খামার করতে যেসব অনুমতির দরকার পড়ে, তার কিছুই ছিল না সাদিক অ্যাগ্রোর। মোহাম্মদপুর এলাকায় খামারটি রামচন্দ্রপুর খালের পাড় ঘেঁষে ছিল। অথচ খালের প্লাবনভূমির ৩০ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাজউকের কোনো অনুমতিও ছিল না। এমনকি খামারের জন্য নেওয়া হয়নি ট্রেড লাইসেন্সের মতো প্রাথমিক অনুমতিপত্র।
নিভৃত পল্লির অচেনা কোনো প্রান্তে নয়, রাজউকের নাকের ডগায় খাল দখল করে অনুমোদনহীন খামার গড়ে বছরের পর বছর উচ্চমূল্যের গরু-ছাগল বিক্রির মচ্ছব বসিয়েছিল সাদিক অ্যাগ্রো। জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকলে হয়তো সিটি করপোরেশনকেই প্রশ্ন করতেন, এতদিন কোথায় ছিলেন?
রাজউক বা সিটি করপোরেশনের আসল কাজ সম্ভবত অপরাধীদের আড়ালে রাখা। নইলে রাজধানীজুড়ে একের পর এক খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ যজ্ঞ চললেও তারা বিন্দুমাত্র টের পায় না কেন? লাইসেন্স ছাড়া একের পর এক গরু-ছাগলের খামার গড়ে ওঠে, তাদের সুখনিদ্রা ভঙ্গ হয় না। পরিবেশকর্মীরা নিয়মিতভাবে খাল দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার; রাজধানীতে জলাভূমির প্রয়োজনীয়তার কথা বিশদভাবে বলা হয় বারবার; কিন্তু সকলই গরল ভেল! দখল হতে হতে রাজধানীর বেশির ভাগ খালই নালায় পরিণত হয়েছে।
২.
সাদিক অ্যাগ্রো কি ঢাকা শহরে একটিই? রামচন্দ্রপুর খালই কি কেবল দখল হয়েছে? রাজধানীর খাল দখল নিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম দেখা যাক: ক. অবৈধ দখলকৃত ‘শ্যামপুর খাল’ নিয়ন্ত্রণে নিল জেলা প্রশাসন (প্রথম আলো, ২২ মে, ২০২৪); খ. কয়েকটি খাল দখল করে অনেকে হাজারো কোটি টাকার মালিক, (প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪); গ. সবুজ ও জলাশয় ৩১ শতাংশই দখল (যুগান্তর, ৪ মে ২০২৪); ঘ. ‘কাল’ হচ্ছে খাল দখল (সমকাল, ২ মার্চ ২০২৪)।
দিনের পর দিন খাল দখলসংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলেও সিটি করপোরেশন ও রাজউকের ঘুম ভাঙে না। এই ঘুমিয়ে থাকবার পেছনে বিরাট অঙ্কের প্রাপ্তিযোগ যে আছে, তা সহজে বুঝে নেওয়া যায়। রাজস্ব কর্মকর্তাপুত্রের ছাগলকাণ্ডের পর গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা তিন দিন অভিযান পরিচালনা করেন ঢাকা উত্তর সিটির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বির আহমেদ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ওই দিন (বৃহস্পতিবার) আংশিক ভেঙে তাদের ট্রেড লাইসেন্স, ফার্মের স্থাপনা নির্মাণের অনুমতিপত্র চাওয়া হয়েছিল। তারা সেদিন কিছুই দিতে পারেনি। সেদিন তারা নিজেরাই ভেঙে দেবে বলে দুই দিন সময় নিয়েছিল। গতকাল গিয়ে দেখা যায়, ভাঙেনি। তাই বাকিটাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় কোনো খামার করার সুযোগ নেই।’
একটি প্রতিষ্ঠান দিব্যি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে, আপনি– মাননীয় উত্তর সিটি কর্মকর্তা এতদিনে তার ট্রেড লাইসেন্স, স্থাপনা নির্মাণের অনুমতিপত্র দেখতে চাইছেন? কত বছরের পুরোনো আবাসিক এলাকা মোহাম্মদপুর, এখানে খামার করবার সুযোগ নেই, এটা আপনারা বুঝতে পারছেন এতদিনে! ঘনবসতিতে খাল দখল করে রীতিমতো গরু-ছাগলের হাট বসিয়ে দিয়েছে; এতদিনে এসেছেন ভাঙচুর করে সংবাদমাধ্যমে দেখাতে যে প্রশাসন কাউকে ছাড় দিচ্ছে না! হতাশায় হতভম্ব হয়ে থাকা ছাড়া উপায় খুঁজে পাওয়াই আসলে কঠিন!
৩.
সাদিক অ্যাগ্রো আসলে কীসের প্রতীক? সাদিক অ্যাগ্রো আমাদের দেশের চলমান প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিহীন ভোগ বিলাসিতার প্রতীক। তরুণটি ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগল কিনতে যায় কোন গরমে? কীভাবে সে বেড়ে উঠেছে? এক দিনেই সে পকেটে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে ছাগল কিনতে ছুটে যায়নি। দুর্নীতির টাকায় মতিউর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের প্রথম পুত্রকে অগাধ প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন।
অঢেল অর্থ মতিউরের পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে বেপরোয়া করে তুলেছিল। ছাগলকাণ্ডের পর দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে মতিউর ও তাঁর পরিবারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এ নিষেধাজ্ঞায় আরও রয়েছেন প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ও তাদের ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব। কানিজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে এক বছরের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদও পান। দুই বছর আগেও স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অপরিচিত লায়লা কানিজের এই উত্থানের পেছনে স্বামীর অর্থের দাপট ছাড়া আর কী থাকতে পারে?
মতিউর আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ কোথায় পেয়েছিলেন? রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদের চাকরিই তাঁর আলাদিনের চেরাগ। তিনি একাই সব আয় করে বসে আছেন; এমন ভাবনাও ঠিক নয়। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও দেশের অগণতান্ত্রিক, জবাবদিহিহীন কাঠামোকে তিনি চেরাগের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন সাদিক অ্যাগ্রো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় রাজধানীর খাল দখল করে নিরুপদ্রবে কোটি টাকার ব্যবসা ফেঁদেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউই আপত্তি করেনি। মতিউরের বেলাতেও তাই। কোনো আপত্তি বা জবাবদিহিতার প্রশ্নই ওঠেনি। বিদ্যুৎ গতিতে সাদিক অ্যাগ্রো ভেঙে চুরমার করে দেওয়া বা মতিউরকে ওএসডি বা বরখাস্ত করা উদ্ভূত সমালোচনামুখর পরিস্থিতিকে ধামাচাপা দিয়ে আপাতত শান্ত করা ছাড়া তাই আর কিছুই মনে হয় না।
অগণতান্ত্রিক সমাজের অব্যবস্থাপনাকে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তাব্যক্তিরা আলাদিনের চেরাগের মতোই ব্যবহার করেন। কোনো কোনো ছিদ্রপথে আলাদিনের চেরাগের খোঁজ সাধারণ মানুষের সামনে আসে। সাদিক অ্যাগ্রো সেই রকম একটি ছিদ্রপথ মাত্র।
মাহবুব আজীজ: সাহিত্যিক; সমকালের উপসম্পাদক
[email protected]
- বিষয় :
- সাদিক অ্যাগ্রো