কাস্টমস অটোমেশন
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা যেভাবে হিরো হতে পারতেন

জাকারিয়া স্বপন
জাকারিয়া স্বপন
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪ | ২৩:৫৮ | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪ | ২৩:৫৮
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা সম্প্রতি পাস হওয়া ‘দ্রুত পণ্য খালাস আইন’ বাতিল চেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। গত ৩ জুলাই সমকালের শিরোনাম– ‘দ্রুত পণ্য খালাস আইন বাতিলের দাবিতে শাহজালালে বিক্ষোভ’। এটাকে ‘কালো আইন’ ঘোষণা করে আয়োজিত সমাবেশে একজন নেতার বক্তব্য টেলিভিশনে দেখে থ হয়ে গেছি।
তিনি রীতিমতো মাইকে বলছেন, কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের কেউ নতুন আইনে পণ্য খালাস করলে তাকে গণপিটুনি দেওয়া হবে। মানুষের কল্যাণে সরকার নতুন আইন করেছে, আর সিঅ্যান্ডএফ নেতারা গণপিটুনির হুমকি দিচ্ছেন!
২. ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে মূলত দুই উপায়ে মালপত্র আসে। একটি, এলসি খুলে সাধারণত বড় পণ্য আনা; অপরটি দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
কুরিয়ারে মূলত আসে ছোটখাটো জিনিস ও ডকুমেন্টস, যা দ্রুত সময়ে গ্রাহকের হাতে চলে আসতে পারে। এগুলো শুল্কমুক্ত কিংবা শুল্কযুক্ত দুটোই হতে পারে। যদি পণ্যটি (যেমন ডকুমেন্ট) শুল্কমুক্ত হয়, সেগুলো কাস্টমস নীতিমালা অনুযায়ী কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই খালাস করতে পারে। পণ্যটিতে যদি শুল্ক প্রযোজ্য হয়, তাহলে কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান আগের আইনে নিজে ছাড়াতে পারত না। ‘সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট’ কাস্টমস সিস্টেমের মাধ্যমে অ্যাসেসমেন্ট ও শুল্ক পরিশোধ করে পণ্যটি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়।
বিদেশ থেকে এমন ছোটখাটো জিনিস এনে ঝামেলায় পড়েনি, এমন মানুষ এ দেশে পাওয়া যাবে? ডকুমেন্ট বা ই-কমার্সে কেনা পণ্য ছাড়াতে গিয়ে কত রকমের ঝামেলা, সেটা ভুক্তভোগীরাই শুধু জানেন।
গত ৬ জুন পাস হওয়া আইনটির আওতায় বিদেশ থেকে আমদানি ছোটখাটো পণ্যের চালান কুরিয়ার শাখা থেকে দ্রুত খালাস করা যাবে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ক. ডকুমেন্ট, খ. নমুনা ও উপহারসামগ্রী, গ. ই-কমার্স পণ্য, ঘ. ৩০ কেজির কম ওজনের অন্যান্য পণ্য। গ্রাহক চাইলে (বাধ্যবাধকতা নয়) এসব পণ্য নতুন আইনের বলে কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ছাড়াতে পারবে। দ্রুততম সময়ে গ্রাহক পণ্যগুলো হাতে পেয়ে যাবেন বলে এটাকে বলা হচ্ছে ‘এক্সপেডাইটেড শিপমেন্ট’। তবে এই চার পণ্যের বাইরে বাকি সবকিছু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরাই করবেন। উল্লেখ্য, গ্রাহক যদি সব পণ্যই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে ছাড়াতে চান, সেটাও করা যাবে।
তথ্য-উপাত্ত থেকে বোঝা যায়, এই প্রক্রিয়ায় বিমানবন্দর কাস্টমসের ৫ শতাংশও কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো খালাস করবে না। সিঅ্যান্ডএফরা কেন গ্রাহকের জন্য সামান্য সুবিধাজনক ও ন্যায্য কাজটি হতে দিচ্ছেন না, সেটাই বড় প্রশ্ন। কেন পুরো ব্যবস্থাকে জিম্মি করা হচ্ছে?
৩. নতুন আইনটি কিন্তু আকাশ থেকে পড়েনি। গত ২৮ এপ্রিল ‘জাতীয় লজিস্টিক নীতি, ২০২৪’ পাস হয়েছে। সরকারি সেই গেজেটের ‘পরিশিষ্ট ০৩, লজিস্টিক খাতের বিস্তারিত নীতি সংস্কার প্রস্তাবনা’র ৩.১ দফায় বলা হয়েছে, ‘লজিস্টিক খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিশ্চিতকরণে কার্যকর কৌশল এবং সমাধান তৈরির লক্ষ্যে লজিস্টিক খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজনের সমন্বয়ে বিশদ আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে ওই খাতের প্রধান প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং সমাধানে প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার ও প্রক্রিয়া সহজীকরণ-বিষয়ক সুপারিশমালা/প্রস্তাবনা চিহ্নিতকরণ’ হয়েছে।
প্রথমত, অংশীজন চিহ্নিত মুখ্য সমস্যাবলি কী? আন্তর্জাতিক এয়ার এক্সপ্রেস প্রদানকারীদের সেলফ ক্লিয়ারেন্স সুবিধার অভাব, যার জন্য অবাঞ্ছিত জটিলতার সৃষ্টি এবং সময় ব্যয় হয়।
দ্বিতীয়ত, অংশীজন প্রস্তাবিত সংস্কার প্রক্রিয়া কী? সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইসেন্সের জন্য ৪৯ শতাংশের অধিক শেয়ারধারী বিদেশি কোম্পানির জন্য বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলে তারা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে পণ্য চালান খালাস করতে পারবে। এতে জটিলতা ও ব্যয় হ্রাস পাবে।
তৃতীয়ত, প্রস্তাবিত প্রযোজ্য সংস্কার কী? কাস্টমস এজেন্ট লাইসেন্সিং বিধিমালার সংশোধন।
পাশাপাশি ডব্লিউটিও ‘ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এর ৭.৮ অনুচ্ছেদে ‘এক্সপেডাইটেড শিপমেন্ট’ বিষয়ে পরিষ্কার বলা হয়েছে, সদস্য দেশ হিসেবে আমাদের দ্রুত মাল খালাসের ব্যবস্থা করতে হবে, ইলেকট্রনিক পেমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে, সবকিছুতে ট্রান্সপারেন্সি আনতে হবে এবং কমপ্লায়েন্স হতে হবে। পুরোটা পড়তে আগ্রহীদের জন্য লিংক: https://tfadatabase.org/en/tfa-text/measure/22।
বস্তুত দীর্ঘদিন ধরে পর্যালোচনার পরই বিমানবন্দরে পণ্য ছাড়ের পুরো প্রক্রিয়া অটোমেশন করতে নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই অটোমেশন ছাড়া আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও নেই। সেই অগ্রযাত্রায় বাধা দেওয়া হচ্ছে কেন?
৪. নতুন নিয়মে পণ্য দ্রুত খালাস হবে; সেটা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নেতারা না চাইবার কী কারণ থাকতে পারে? তারা কি চাইছেন না– ক. গ্রাহকের ভোগান্তি ও খরচ কমুক? খ. কাস্টমস সিস্টেম অটোমেটেড ও ট্রান্সপারেন্ট হোক, যাতে গ্রাহক ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শুল্ক পরিশোধ করে দ্রুততম সময়ে ঘরে বসেই তার পণ্যটি পেয়ে যাক? গ. দেশে ই-কমার্স সেবা সুচারু এবং ক্রস-বর্ডার শিপমেন্ট স্বাচ্ছন্দ্যের হোক? ঘ. দেশের কুরিয়ার সেবা উন্নত হোক এবং প্রবাসীরা আত্মীয়স্বজনের জন্য নির্বিঘ্নে উপহার পাঠাক?
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ যে ছোটখাটো প্যাকেট নতুন আইনে কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো গ্রাহক চাইলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দিয়েও ছাড়াতে পারবেন। আর ৩০ কেজি ওজনের ওপরের সব পণ্য তো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরাই ছাড় করবেন! তবুও তারা গ্রাহকের স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে কেন আন্দোলন করছেন? তারা কি চান না, দেশটা সামনে এগিয়ে যাক?
৫. সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের আন্দোলন দেখে মনে হতে পারে, তাদের পুরো ব্যবসাই বোধ হয় কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে কুরিয়ার সার্ভিসকে দেওয়া হয়েছে টাকার অঙ্কে ৫ শতাংশেরও কম অংশ, যা অটোমেশনের আওতায় আসতে যাচ্ছে।
ছোটখাটো যেসব পণ্য কুরিয়ারের মাধ্যমে আসে, সেগুলোর দাম খুব কম; ফলে শুল্কও খুব কম। প্রকৃত চিত্র হলো, এ পণ্যগুলো ছাড়ানোর জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের তেমন আগ্রহও থাকে না। আমার নিজের বেলাতেই এমন অনেকবার হয়েছে। ফেডএক্সে প্যাকেট এসেছে; শুল্ক দিতে হবে মাত্র ১২০০ টাকা। এত কম টাকায় কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের আগ্রহ নেই। প্যাকেটটি দিনের পর দিন কাস্টমসের গোডাউনে পড়ে থাকে। এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়?
যন্ত্রণা শেষ হবার দেশ সম্ভবত বাংলাদেশ নয়! যখনই সেই পদ্ধতিতে অটোমেশন আনার কথা বলা হয়, তখনই আমরা রাস্তায় নামি, মিছিল-ভাঙচুর করি। এবার তো প্রকাশ্যে গণপিটুনির হুমকি দেওয়া হলো! শক্তির এমন অপব্যবহার করে, মানুষ যত কষ্টই করুক, লাভ আমার চাই।
২০২৪ সালে এসে একটি দেশে কীভাবে অটোমেশনের বিরুদ্ধে বাধা আসতে পারে! কীভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভয়ের রাজত্ব তৈরি করতে পারে! ওদিকে আমরা স্বপ্ন দেখছি, বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যেই উন্নত দেশে পরিণত করে ফেলব! দুঃস্বপ্ন আর কাকে বলে!
৬. অথচ পুরো বিষয়টি ঠিক উল্টো হতে পারত!
নতুন আইনে যখন দ্রুত প্যাকেট খালাস করা যাবে বলা হলো, তখন সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন স্বাগত জানিয়ে মিছিল করতে পারত। এখনও সময় আছে, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নিচের কাজগুলো করে এখনও হিরো হয়ে যেতে পারে–
ক. গ্রাহকবান্ধব নতুন আইনকে সাধুবাদ জানিয়ে বিবৃতি এবং এনবিআরের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।
খ. দ্রুত অটোমেশনে সহযোগিতা করা; নিজেরাও অটোমেশনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়ে কেউ হিরো হতে পারে না, অ্যান্টি-হিরো হতে পারে।
গ. গ্রাহকরা কেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের বদলে কুরিয়ারের কাছে যেতে চায়, সেটা গভীরভাবে ভাবতে হবে। কেন এমন ভাবমূর্তি সংকট তৈরি হলো?
ঘ. মনে রাখতে হবে, পেশিশক্তি নয়, যুক্তিই শেষ পর্যন্ত টেকসই হয়। দেশ যত উন্নত হতে থাকবে, পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য তত কমতে থাকবে। বরং সময় থাকতেই ছোট কুরিয়ারগুলোর ওপর চেপে না বসে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়ানো উচিত।
ঙ. এই আন্দোলন মিডিয়ার মাধ্যমে পুরো জাতি দেখছে, সরকারও দেখছে। এটাই ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের জন্য হিরো হওয়ার সবচেয়ে মোক্ষম সময়। তারা কি সেই সুযোগটি মিস করতে যাচ্ছে?
জাকারিয়া স্বপন: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক
[email protected]
- বিষয় :
- কাস্টমস হাউস