জনজীবন
যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন

ফাইল ছবি
খুশী কবির
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৪ | ১৪:৩০ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪ | ১৪:৩২
পরিস্থিতি শান্ত করতে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে। বিশেষ করে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী ও মানুষদের আস্থায় নিতে হবে। তবে কোটাধারী শিক্ষার্থীরা আমার বিশ্বাস, আন্দোলন বন্ধ করে ক্লাসে ফিরে যাবে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও সরকার দ্রুত খুলে দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মনে রাখতে হবে, চলমান দম বন্ধ পরিবেশ সবার জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনবে।
কোটা আন্দোলন ঘিরে পরিস্থিতি যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। গত কয়েক দিনে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বিটিভিসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা হয়েছে। এটা ঠিক, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। সরকারি চাকরিতে অর্ধেক সংখ্যকের বেশি কোটা থাকার সংকট সবাই অনুধাবন করে এর যৌক্তিক সমাধান চেয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও কোটা সংস্কারের পক্ষে, তবে একেবারে বাতিলের পক্ষে নই। ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া এ আন্দোলন এক পর্যায়ে ভিন্নদিকে মোড় নেয়। রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাঈদকে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি যেভাবে হয়েছে, তাতে স্পষ্ট– শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সুযোগসন্ধানীরা ঢুকে পড়েছে। সরকার অবশেষে কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কোটা সংস্কারের আন্দোলন অনেক দিনের। বিশেষ করে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনের দাবিতে রাস্তায় নামে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে কোটা পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়। এর পর সংক্ষুব্ধ হলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। গত জুন মাসে আদালতের আদেশের মাধ্যমে কোটা ফিরে এলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। বিশেষ করে চলতি মাসের শুরু থেকেই এর ব্যাপকতা লাভ করে। তা এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথমদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল অহিংস। কিন্তু রংপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আবু সাঈদের গুলির ঘটনাটি ছিল পরিস্থিতি মোড় ঘোরানো ঘটনা। আমাদের প্রশ্ন, পুলিশ কেন শিক্ষার্থীদের ওপর এভাবে গুলি করবে? ছেলেটা নিরস্ত্র ছিল; আবেগবশত বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অথচ সেই আবেগভরা বুকেই একের পর এক গুলি করা হলো! তাঁর মা আক্ষেপ করে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় যা বলেছেন, তা হলো– ছেলেটাকে চাকরি না দিলে না দিবি, কিন্তু মারলি কেন? এর জবাব আমরা কীভাবে দেব?
বস্তুত গত মঙ্গলবার রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে প্রাণহানির পরই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তীব্রতর হয়। এমনকি এর সুযোগ নেয় সুযোগসন্ধানীরা। আন্দোলন ঘিরে আমরা দেখেছি হঠকারিতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক সব কর্মকাণ্ড। এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ একেবারে নজিরবিহীন। রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, মেট্রোরেলকে অচল করে দেওয়া, সেতু ভবনে আক্রমণ, রাষ্ট্রীয় ভবনের ভেতরে গিয়ে তাণ্ডব চালানো। সারাদেশে পোড়ানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক যানবাহন। এ ছাড়া নরসিংদী জেলা কারাগারে ভয়াবহ হামলা-ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পালানোর সুযোগ দেওয়া হয় বন্দিদের। এসব নাশকতায় বিপুল ক্ষতি হয়েছে। তবে এগুলো যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নয়– সেটা তারাও নিশ্চিত করেছে। নরসিংদীতে কারাগার থেকে পালানো কয়েদিদের মধ্যে দুর্ধর্ষ জঙ্গিরাও ছিল। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি নাশকতা হয়েছে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা ও মহাখালী এলাকায়। তার মানে, যারা কোটা আন্দোলনকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, তারা ছিল সুসংগঠিত। পরিকল্পিতভাবে তারাই এহেন রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ করেছে। এটা খুব ভয়াবহ ঘটনার ইঙ্গিত। কারা এসব অপরাধে জড়িত, তাদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।
একদিকে ইন্টারনেট নেই, অন্যদিকে জরুরি অবস্থার কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। এ সময়ে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। বাজার করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটায় সমস্যা হচ্ছে। সবচাইতে বেশি সংকটে পড়েছে দিনমজুর মানুষ। তারা কাজ না করলে খেতে পারবেন না। অর্থনৈতিকভাবে ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইন্টারনেটের সঙ্গে যাদের বাণিজ্য জড়িত, তারা কী করবেন? এমনকি চট্টগ্রামে আমদানি-রপ্তানি কাজেও যে অচলাবস্থার খবর আমরা দেখছি, তাতে এমন সংকটে দেশের অর্থনীতি সমস্যায় পড়বে। সে জন্যই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া সবার জন্য কল্যাণকর।
কোটা সংস্কারের আন্দোলন সমাধানে আদালতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের রায় আরও বিলম্বিত হওয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় রোববার সেটি এগিয়ে আনা হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে আপিল বিভাগ কোটা সংস্কারে বহুল প্রতীক্ষিত রায় দেন। রায়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের কথা বলা হয়। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৫ শতাংশ, আদিবাসীদের জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য ১ শতাংশ কোটায় নিয়োগের কথা বলা হয়।
আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়েই বলতে চাই, নারীদের জন্য এখনও কোটা প্রয়োজন। সংবিধানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার জন্য কোটা ব্যবস্থার কথা বলা হয়। আগে যেভাবে ৫৬ শতাংশ ছিল, সেখান থেকে যৌক্তিক সংস্কারই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। তবে পরিস্থিতির আলোকে আদালতের রায়কে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাই। কোটা বিষয়ে, সর্বশেষ এটাও বলা দরকার। যারা প্রাথমিক বাছাই ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তারাই কেবল ভাইভায় এসে কোটায় চাকরির জন্য বিবেচিত হয়। অর্থাৎ কোটাধারীরা মেধাবী নয়– আমরা এমনটা বলতে পারি না।
এখন পরিস্থিতি শান্ত করতে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে। বিশেষ করে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী ও মানুষদের আস্থায় নিতে হবে। তবে কোটাধারী শিক্ষার্থীরা আমার বিশ্বাস, আন্দোলন বন্ধ করে ক্লাসে ফিরে যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও সরকার দ্রুত খুলে দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। মনে রাখতে হবে, চলমান দম বন্ধ পরিবেশ সবার জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনবে। আদালতের মাধ্যমে কোটার যে সমাধান এসেছে, সেটা আন্দোলনকারীদের দাবির কাছাকাছি। অর্থাৎ তারা ৫ শতাংশ কোটা চেয়েছে, সেখানে আদালত নানাদিক বিবেচনায় ৭ শতাংশ ধার্য করেছে, তাও বিশেষ পরিস্থিতির কারণে।
সবচেয়ে বড় কথা, এত প্রাণহানির ঘটনা অনভিপ্রেত। পরিস্থিতি কেন এতটা খারাপ হলো? এখানে কাদের ইন্ধন ছিল? পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর এসব খতিয়ে দেখতেই হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ অতিউৎসাহী হয়ে কিছু করেছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা চাই। এমন অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে প্রশাসনিক ব্যর্থতাও দেখতে হবে। সরকার আন্দোলনকারীদের শুরুতেই গুরুত্ব দিলে হয়তো এমন হতো না, কিংবা দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ পেত না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির পর্যালোচনা দরকার। মানুষ চলাফেরার অধিকার দ্রুত ফিরে পাক, সেটাই কাম্য।
খুশী কবির: সমন্বয়ক, নিজেরা করি
- বিষয় :
- খুশী কবির