ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

রাষ্ট্রচিন্তা

রক্ষণশীল নারীবিরোধী শক্তির দাপট বিশ্বজুড়েই বাড়ছে?

রক্ষণশীল নারীবিরোধী শক্তির দাপট বিশ্বজুড়েই বাড়ছে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৩ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৩

পুঁজিবাদের দাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রক্ষণশীলরা নানা উপায়ে ক্ষমতায় বসে গেছে এবং মানুষের ওপর অত্যাচার বাড়িয়েই চলেছে। ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার যে দুর্নীতিতে পারঙ্গম– সেটি সেখানকার মানুষ খুব ভালোভাবেই জানে। কিছু মানুষ যে মাঝেমধ্যে বিক্ষোভ জানায় না, তাও নয়। কিন্তু সরকার তো মহাআনন্দে প্রতিদিন অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর অস্ত্র দাগছে; হত্যা করছে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব চুপ করে আছে। ন্যায়-অন্যায়ের লড়াইতে চুপ থাকা মানেই তো অন্যায়কে সমর্থন দেওয়া। আরব বিশ্বও আত্মীয়দের মরণাদশা দেখে কাতর হবে কি, কেউ কেউ তো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে উদগ্রীব। অর্থাৎ ইসরায়েলকে সমর্থনই দিচ্ছে। আরব বসন্ত একদা যে নতুন হাওয়া আনবে, মনে হয়েছিল। সে-হাওয়া হারিয়ে গেছে তপ্ত মরুভূমিতে। ওদিকে ইরাক ছারখার, ইরান বিপন্ন। 
চরম দক্ষিণপন্থি তালেবান আবার আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছে। আর তাদের তুলনায়ও যারা কট্টরপন্থি ও হন্তারক সেই ইসলামিক স্টেট তালেবান শাসনেও সন্তুষ্ট নয়। তারা আরও ‘উন্নত’ ও মূর্ত ইসলামী শাসন চায় এবং সেটি কায়েম করবার লক্ষ্যে মানুষ হত্যার আয়োজন করে থাকে। তালেবানের নিজেদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে, সেটি থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে তুলনামূলক যারা গরম, কর্তৃত্বের দড়ি যে তাদের হাতেই সেটি টের পাওয়া যায় নারীশিক্ষার প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি দেখলে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের জন্য শিক্ষা ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এমনকি মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত হতেও পারবে না– এমন কানুন জারি করা হয়েছে। মেয়েরা বসে থাকেনি, তারা প্রতিবাদ করেছে, তাদের সঙ্গে ছেলেরাও যোগ দিয়েছে ভীতি উপেক্ষা করে; মানববন্ধন হয়েছে। সে ফেস্টুনে লেখা হয়েছে– ‘ইকরা’, যার অর্থ পড়ো এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে– আল্লাহতালা রাসুলের কাছে যে বাণী পাঠিয়েছিলেন তাতে প্রথম কথাটাই ছিল ওই ‘পড়ো’। কিন্তু এসব যুক্তিতে কান পাতার পাত্র নয় কট্টরপন্থি তালেবান। তাদের মতে, ইসলাম সম্পর্কে তারা যা বলবে সেটিই ঠিক। 

তালেবান এক সময়ে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকদের; ওই রাষ্ট্রের বর্তমান শাসকরা টের পাচ্ছে কোন ভয়ংকর শক্তিকে তারা প্রশ্রয় দিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের শাসকরাও তো পুঁজিবাদী; যেমন আরও পুঁজিবাদী হচ্ছে তাদের এককালীন মিত্র আমেরিকানরা। 
বসন্তের হাওয়া নয়, বিপ্লবের ঝড়ই বয়ে গিয়েছিল ইরানের ওপর দিয়ে। তাতে বাদশাহতন্ত্রের পতন ঘটেছে। ইরানের তেল সম্পদের ওপর জাতীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাহি শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে সমাজতন্ত্রীরা ছিল; যেমন ছিল ধর্মীয় মৌলবাদীরাও। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা ছিল বিভক্ত; মৌলবাদীদের ভেতর এক ধরনের ঐক্য কায়েম ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে গেল ওই ধর্মীয় মৌলবাদীরা; সমাজতন্ত্রীরা বিতাড়িত হলো। অনেকে প্রাণও হারালো। রাষ্ট্রীয় বিপ্লব ছিনতাই হয়ে গেল। ফলে প্রয়োজনীয় ও প্রত্যাশিত প্রগতিমুখী সমাজ বিপ্লবটি আর ঘটল না। মৌলবাদীরা বিশেষভাবে হস্তক্ষেপ করল মেয়েদের স্বাধীনতার ওপর। 

সাংস্কৃতিকভাবে ইরান কেবল প্রাচীন নয়; অনেক উন্নত এবং ছিল সম্পদশালীও। ইরানিরা আরবদের কাছ থেকে ধর্ম নিয়েছে, কিন্তু ভাষা নেয়নি। ফারসি কেবল ইরানের নয়, ছিল আরও কয়েকটি দেশের রাজকীয় ভাষা। অগ্রসর সেই সমাজে মেয়েদের অগ্রগতিকে স্তব্ধ করার যে চেষ্টা মৌলবাদীরা শুরু করল, সেটি এখনও অব্যাহত। সেখানে নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্বে বিশেষ বাহিনী কাজ করছে। তারা মেয়েদের জামাকাপড়ের ‘শালীনতা’ ঠিকঠাক আছে কিনা, বিশেষভাবে লক্ষ্য করে থাকে। একটি কিশোরী তার মায়ের সঙ্গে বিপণিকেন্দ্রে গিয়েছিল। মাথার কাপড় ঠিক ছিল না– এই অপরাধে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখে এবং আটক অবস্থাতে তার মৃত্যু ঘটে। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়বার পর প্রথমে তুমুল ক্ষোভ প্রকাশ পায় এবং পরে বিক্ষোভ শুরু হয়। মেয়েরা প্রতিবাদ করে। প্রগতিপন্থি পুরুষরাও তাতে যোগ দেয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিন্তু অনড়। তারা ‘নৈতিকতা’ রক্ষা করবেই, কোনো প্রকার ছাড় দেবে না। ফলে গুলি বর্ষণের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। নিহত হয় অন্তত ৫০০ জন; তাদের মধ্যে ৬৯ জন শিশুও রয়েছে। বিক্ষোভে অংশগ্রহণের দায়ে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। 

ধর্মীয় মৌলবাদী ও পুঁজিবাদীদের ভেতর বিস্তর ব্যবধান। এক দল প্রাচীনপন্থি, অন্যদল আধুনিক; কিন্তু তাদের মধ্যে চমৎকার মিল রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে আস্থার ব্যাপারে। এই আস্থা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশ দেখা যায় মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও। উভয় দলই মেয়েদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে ধরে নেয়। তাই দেখা যায় মৌলবাদীদের শাসনে নারীর অধিকার সীমিত করে ফেলা হয়। পারলে তাদের অস্তিত্বকেই ঢেকে রাখার চেষ্টা চলে আবরণ দিয়ে; অন্যদিকে পুঁজিবাদী আধুনিকেরা মেয়েদের পোশাক দেয় ছোটখাটো করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না নারী-ধর্ষণ। 
বাংলাদেশের সমাজে অধিকাংশ নারীই মৌলবাদী শাসনের অধীনে বসবাস করে। তবে তারা ওই বন্ধন ছিন্ন করতে যে চেষ্টা করে না, এমনও নয়। গার্মেন্ট শ্রমিক বেশির ভাগই নারী। তারা মৌলবাদী পিতৃতান্ত্রিক অবরোধের তোয়াক্কা করে না। সাম্প্রতিককালে যেটি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে, সেটি হলো কিছু সংখ্যক মেয়ে বিদেশেও যাচ্ছে, কাজের খোঁজে। বিদেশে গিয়ে তারা বিপদে পড়ে, সে-সব বিপদের মধ্যে যৌন হয়রানিই প্রধানতম। তবু তারা যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা ভাঙতে চাইছে, সেটিই তাৎপর্যপূর্ণ। 

মেয়েরা ক্ষুদ্রঋণ করে এবং ঋণগ্রস্ত হলে তাদের কারও কারও অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায়, তার দৃষ্টান্ত অসংখ্য। আত্মহত্যা করতে পর্যন্ত বাধ্য হয় ঋণের টাকা জোগাড় করতে না পারার কারণে। এনজিওগুলো চিনা জোঁকের মতো চেপে ধরে কিস্তি আদায়ে। 
আমরা বলে থাকি এবং কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সত্য বলে জেনে নিই যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। অর্জিত হলে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান না ঘটুক, অন্তত তার দাপটটা কমত। ঘরে-বাইরে মেয়েদের লাঞ্ছনা কম হতো। মেয়েদের চরমতম লাঞ্ছনা ঘটেছে একাত্তরে; হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে। কিন্তু তা যে এখনও শেষ হয়নি, সেটি পথেঘাটে প্রকাশ্যে সংঘটিত নারী লাঞ্ছনার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×