সুশাসন
কর অডিটের হয়রানি কমবে কবে?

প্রতীকী ছবি
দৌলত আকতার মালা
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৮
কর আদায়ে ধীরগতি দেশের অর্থনৈতিক খাতের বড় সমস্যা। নানা চেষ্টায়ও কর-জিডিপি হার বাড়ানো যাচ্ছে না। কর কর্মকর্তারা অডিট বা নিরীক্ষার মাধ্যমে কর ফাঁকি উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন; তাতেও সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা।
বস্তুত আয়কর ফাইলের অডিট নিয়ে সমালোচনা দীর্ঘদিনের। প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে ব্যবসায়ীদের দাবি উঠে আসে– ‘অডিটের নামে কর বিভাগের হয়রানি বন্ধ হোক’। অনেক সাধারণ করদাতাও দাখিলপত্র অডিটের নামে হয়রানির অভিযোগ করেন। কর ফাইল অডিট কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতার অতি প্রয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। আয়কর ফাইল যদি কোনো কারণে অডিটের জন্য নির্বাচিত হয়, সেই করদাতার আর নিস্তার নেই। কিছু না কিছু কর ফাঁকি খুঁজে পেতে বের করবেনই কর কর্মকর্তা। এতে অনেক সময় ঘুষ লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
কৌতুক প্রচলিত– লেবু চিপে রস বের করার প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। প্রতিযোগীরা সাধ্যমতো রস বের করলেন। সবার শেষে এক ভদ্রলোক উঠে ছোবড়া লেবু থেকেই সবার চেয়ে বেশি রস বের করলেন। সবাই অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, তাঁর পেশা কী? জানা গেল, তিনি আয়কর কর্মকর্তা। ছোবড়া লেবুর মতোই যে কোনো আয়কর ফাইল থেকে কর ফাঁকি বের করা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়।
এটিও সত্য, বেশির ভাগ করদাতা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না, তিনি শতভাগ কর দেন। আয়কর কর্মকর্তা যদি চান, খুঁজে পেতে তাঁর কিছু না কিছু কর ফাঁকি বের করতেই পারবেন।
‘অডিট নির্দেশনা’ বলে আয়কর বিভাগের একটি আদেশ আছে। সেখানে ‘ঝুঁকিপূর্ণ দাখিলপত্র’ কেমন হবে, সেটি নির্দিষ্ট করা থাকে। মজার ব্যাপার হলো, সেই নির্দেশনা এত ব্যাপক ও বিস্তৃত, কোনো করদাতাই বাইরে থাকেন না, সবাই অডিটের যোগ্য।
আয়কর দাখিলপত্র অডিট নিয়ে বেশ বাণিজ্য হয়। কর কর্মকর্তা ছাড়াও কিছু পেশকার, কম্পিউটার অপারেটর, কিছু আয়কর আইনজীবী করদাতাদের ফাইল অডিটে পড়ার ভয় দেখান– ঠেকাতে হলে ‘কিছু খরচাপাতি’ লাগবে। সাধারণ আয়করদাতারা সহজেই এ ফাঁদে পা দেন। একবার পরিচিত একজন আমাকে ‘অডিটে পড়া’ তালিকা পাঠালেন, সেখানে তাঁর নামও আছে। তাঁর আয়কর ফাইল যিনি দেখভাল করেন, তিনিই তালিকাটি পাঠিয়েছেন। নাম কাটাতে চাইলে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। বেচারা সীমিত আয়ের চাকরিজীবী। সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের কমিশনার আমার পরিচিত। জানতে চাইলাম, ‘অডিট তালিকা’ করছেন কিনা? তিনি জানালেন, কাজই শুরু হয়নি এখনও। তালিকাটি দেখাতেই বললেন, এটি ভুয়া।
কর দাখিলপত্র অডিট নিয়ে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে। অডিটের হুমকিধমকি দিয়ে যেমন হয়রানি হয়, তেমনি হয় অযথা অডিটে ফেলে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কর ফাইল যে যুক্তিতে অডিটে ফেলা হয়েছিল, তেমন হাজারো ফাইল খুঁজলে পাওয়া যাবে। কোন দাখিলপত্রটি অডিটে ফেলতে চান ডেপুটি কর কমিশনার, সেটিই আসল বিষয়।
গত দেড় দশকের আওয়ামী লীগ শাসনামলে বা তার আগে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সরকারের সময় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শায়েস্তা করতে কর বিভাগকে ব্যবহার করা হতো। এখনও সেটির পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। যদি কর ফাঁকির উপাদান দাখিলপত্রে থাকে, নিশ্চয় অডিটে ফেলা উচিত; তিনি যিনি হোন না কেন। কিন্তু বিষয়টি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিচালিত হয়ে আসছে। যেমন আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের এবং বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেতাদের কর ফাইল নিয়ে টানাহেঁচড়া চলে। আর ওয়ান-ইলেভেন আমলে দুই দলের নেত্রীরই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হলেও খালেদা জিয়ার অ্যাকাউন্ট দীর্ঘ ১৭ বছর অপরিচালনযোগ্য ছিল। যদিও আয়কর আইন অনুযায়ী এ ধরনের আদেশের মেয়াদ সর্বোচ্চ এক বছর। এক বছর পর ব্যাংক হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চালু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনামলে খালেদা জিয়ার ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার সাহসই হয়নি ব্যাংক বা আয়কর বিভাগের।
অডিট বা কর আরোপ করে হয়রানির বহুল প্রচলিত শাস্তি ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হলেই কর বিভাগ তৎপর হয় বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তল্লাশি, ফ্রিজ করায়। মনে হয়, সরকার বিদায়ের আগ পর্যন্ত কর বিভাগ ঘুমন্ত থাকে।
এক সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আদেশ ছিল– পরপর দুই বা তিন বছর কোনো আয়করদাতাকে অডিটে ফেলা যাবে না। তবে এই আদেশের সঙ্গে একটা ‘কিন্তু’ দিয়ে অবারিত করা হয় অডিটের সুযোগ। শতভাগ আয়করদাতাই এ অডিটে পড়েন, এমন নয়। কিন্তু মাত্র ৩/৪ শতাংশ করদাতার ফাইল অডিটের জন্য নির্বাচিত হলেও সিংহভাগই হুমকির সম্মুখীন হয়।
আমাদের দেশে এখনও কর-সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কোনো দেশেই নিজের অর্জিত টাকা রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দেওয়া পছন্দনীয় ব্যাপার নয়। কিন্তু আমাদের দেশে কর আদায়ের হার, গতি ও পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। আর অডিটের নামে হয়রানি এই চিত্রে আরও নেতিবাচক অবদান রেখে চলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান অবশ্য আদেশ জারি করে সব কর অফিসে নতুন করে অডিট নির্বাচন স্থগিত করেছেন। আদেশে বলা হয়েছে, অডিট নির্বাচন যাতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়, তার কাজ চলছে। পাশাপাশি মধ্যবর্তী আদেশের মাধ্যমে সীমিত আকারে অডিটের সুযোগও রাখা হবে।
নতুন আদেশে অনেক কর কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ। কারণ অডিট না করতে পারলে রাজস্ব টার্গেট অর্জন কঠিন হতে পারে। কিন্তু একটা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধান এবং অসাধু চক্র থেকে মুক্তি পেতে হলে কিছু ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে।
দৌলত আকতার মালা: সাংবাদিক
- বিষয় :
- সুশাসন