ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

পার্বত্য জেলা

পাহাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাচাং ঘর টিকে থাকুক

পাহাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাচাং ঘর টিকে থাকুক

ফাইল ছবি

মাথিন শৈ মারমা

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৮ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৪

দেশের তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠী নানাভাবে নিজেদের শিল্পী সত্তার পরিচয় দেয়। জাতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা ব্যবহার্য পোশাক নিজেরাই তৈরি করে। খাবার তৈরিতেও রয়েছে নিজস্বতা। তবে সব পাহাড়ির মধ্যে বসবাসে একটি মিল আছে। তা হলো, তাদের তৈরি মাচাং ঘর; মারমা ভাষায় ম্রাআং ওইং। এটি এমন একটি ঐতিহ্যবাহী নির্মাণশৈলী, যা সাধারণত মাটিতে খুঁটি গেড়ে তার ওপর নির্মিত। এ ঘরগুলো তৈরি হয় ছন (এক ধরনের খড়) দিয়ে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি দূর থেকে খুবই পরিপাটি মনে হয়।

মাচাং ঘরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর উঁচু অবস্থান। ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা এবং আকস্মিক বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হয়। সাধারণত মাটি থেকে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচুতে তৈরি হয় এই ঘর। মাচাং ঘর তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাঁশ, কাঠ ও ছন। ঘরের মেঝে সাধারণত বাঁশের কঞ্চি বা কাঠের ফ্রেম দিয়ে তৈরি, যা খুঁটির ওপর টিকে থাকে। ঘরের চারপাশে কোনো প্রাচীর না রেখে কেবল বাঁশের বেড়া বা কাঠের রেলিং ব্যবহার করা হয়। ছাদ তৈরি করা হয় ছন বা আধুনিকতার ছোঁয়ায় টিন দিয়ে, যা বৃষ্টি থেকে সুরক্ষা দেয়। ঘরের মূল খুঁটিগুলো তৈরি হয় গাছ দিয়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় বাঁশ দিয়েও খুঁটি তৈরি করা হয়। মাচাংয়ের সঙ্গে খুঁটির যে সন্ধি বা সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বাঁধাই করা হয় বাঁশের বেত দিয়ে। এই বেত তৈরি করা হয় কচি বাঁশ দিয়ে। বাড়ির মাচাংকে ধরে রাখতে মাচাংয়ের সমান্তরাল বাঁশের সঙ্গে খুঁটির প্রতিটি সন্ধিতে মাটি থেকে ঠেস দেওয়া হয়।

মাচাং ঘর নির্মাণের পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণও অস্পষ্ট নয়। যেগুলো আদিবাসী সমাজে এ ধরনের ঘরকে কার্যকর করে তুলেছে। বন্যা থেকে সুরক্ষা তো রয়েছেই; বন্যপ্রাণী থেকে সুরক্ষা, ঠান্ডা বাতাস চলাচল, প্রাকৃতিক উপাদানের সহজলভ্যতা এবং উপযোগী স্থাপত্যশৈলী এর অন্তর্ভুক্ত।

এক সময় তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ব্যাপক ছনের কদর ছিল। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ছনের ঘর তৈরির প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসী এখনও পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছন দিয়ে মাচাং ঘরে বসবাস করছে। কিন্তু কালের বিবর্তন ও জুম চাষের কারণে ছন উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিলুপ্তির মুখে পড়েছে পাহাড়ি ছনের ঘর। আজকাল জঙ্গলে বাঁশ-গাছ পাওয়া যায় না। বাজারে বাঁশের দাম অনেক বেশি হওয়ায় এখন আর মাচাং ঘরের দেখা মেলে না। বাঁশ, বেত আর খুঁটির দাম বেশি হওয়ায় মাচাং ঘরের প্রতি আদিবাসীদের আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে। যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এই ঘর। বর্তমানে সামর্থ্য থাকলেও সচ্ছল ব্যক্তিরা মাচাং ঘর তৈরি করে না। কারণ তিন থেকে চার বছরের বেশি টিকে না। তা ছাড়া বন-জঙ্গলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে প্রচুর গাছ-বাঁশ। তাই খরচ একটু বেশি হলেও স্থায়িত্বের কথা ভেবে অনেকেই ইট-পাথরের ঘর তুলতে আগ্রহী। অবস্থানগত পরিস্থিতির পরির্বতনের কারণে আদিবাসীদের মাচাং ঘর বিলুপ্তির পথে। তা ছাড়া বন উজাড়ের কারণে আগের মতো তেমন কাঠ-বাঁশও পাওয়া যায় না। ঐতিহ্যবাহী মাচাং ঘরকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
আধুনিক সময়ে মাচাং ঘরের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে গেলেও পর্যটন এবং সংস্কৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে এখনও এটি টিকে আছে। বিভিন্ন পর্যটন স্পট ও রিসোর্টে মাচাং ঘরের আদলে কাঠের ঘর তৈরি করা হয়, যা পরিবেশবান্ধব থাকার সুবিধা দেয়। মাচাং ঘর শুধু একটি আবাসন পদ্ধতিই নয়। এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রতীকও বটে।

মাচাং ঘর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা এবং স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন, যা তাদের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে মিলে নির্মিত। এটি কেবল একটি আবাসন পদ্ধতি নয়, বরং প্রাকৃতিক উপাদান ও স্থায়িত্বের মাধ্যমে টিকে থাকার এক চমৎকার উদাহরণ। মাচাং ঘর আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও এই ঐতিহ্য সংরক্ষিত থাকুক– এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মাথিন শৈ মারমা: শিক্ষার্থী, বান্দরবান বিশ্ববিদ‌্যালয়

আরও পড়ুন

×