ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ব্যাংক খাত

তারল্য সংকট দূর ও ঋণ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম একত্রে চলুক

তারল্য সংকট দূর ও ঋণ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম একত্রে চলুক

সাইফুল হোসেন

সাইফুল হোসেন

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৪১

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে বড় ধরনের তারল্য সংকটের মুখোমুখি, যা অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে তারল্য সংকট নিরসনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ১১টি দুর্বল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা; বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া। টাকা সরাসরি না ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বরং তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে সচ্ছল ব্যাংকের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করছে। একই সঙ্গে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকাও জরুরি বলে আমি মনে করি।

তারল্য সংকট ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের সম্পর্ক
বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্বল ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তবে আমানতকারীদের ধরে রাখা, আমানত পুনঃসংগ্রহ এবং ব্যাংকের ভাবমূর্তি পুনঃস্থাপন কার্যক্রমে মনোযোগী হতে গিয়ে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে কম মনোযোগ দিতে পারে। সবাই জানেন, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের একটি খেলাপি বা শ্রেণিকৃত ঋণ পোর্টফোলিও রয়েছে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১.৩৫ ট্রিলিয়ন টাকা, যা দেশের মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ। যদিও প্রকৃত হিসাবমতে, এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ শতাংশের কাছাকাছি। 

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখায়, তারল্য সংকট কাটাতে ঋণ পুনরুদ্ধারে মনোযোগ হারানো মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় দক্ষিণ কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট মোকাবিলায় পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে মনোযোগ হারিয়েছিল, যা পরে তাদের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে দেশগুলো সহায়তা নিতে বাধ্য হয়েছিল। 
এ সমস্যা এড়াতে ব্যাংকগুলোকে দ্বৈত কৌশলে কাজ করতে হবে– একদিকে তারল্য সংকট মোকাবিলা, অন্যদিকে শ্রেণিভুক্ত ঋণ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া।

প্রতারণামূলক ঋণ গ্রহণকারীদের ওপর নজরদারি
এই সময়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কিছু ঋণ গ্রহণকারী অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হলেও ঋণ পরিশোধ না করার পথ বেছে নিতে পারেন। তারা উচ্চ সুদের হারকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ব্যাংককে জানাতে পারেন– তাদের পক্ষে ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয়। এ ধরনের প্রতারণামূলক আচরণ ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে শ্রেণিভুক্ত ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। তাই ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হবে এবং এ ধরনের ঋণ গ্রহণকারীর ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।

এসএমই খাতের ওপর প্রভাব
তারল্য সংকট এবং শ্রেণিভুক্ত ঋণ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে দেশের ছোট ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে। এসএমই খাত দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এবং এই খাতে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংক ঋণ সংকুচিত হলে এসএমই উদ্যোক্তারা সহজে অর্থায়ন পাবেন না।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান এসএমই খাত থেকে আসে এবং দেশের অর্থনীতিতে এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যদি এসএমই খাত অর্থায়নের সংকটে পড়ে, তাহলে দেশব্যাপী কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।

অর্থনৈতিক প্রভাব
তারল্য সংকটের প্রভাব শুধু ব্যাংকিং খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি সামগ্রিক অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো যখন তাদের গ্রাহকদের অর্থ প্রদান করতে অক্ষম হয়, তখন জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং আমানতকারীরা অর্থ তুলে নেয়। ফলে ভালো ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকটে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি শ্রেণিভুক্ত ঋণ পুনরুদ্ধারে যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে সংকট আরও বাড়তে পারে। ব্যাংকগুলো যেসব গ্রাহককে ঋণ প্রদান করেছে কিন্তু পুনরুদ্ধার করতে পারছে না, তাদের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকট আরও গভীরতর হবে। এর ফলে বাজারে চাহিদা কমে যায়। কারণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ পুঁজি না পেলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে না।

সুপারিশ ও পরামর্শ
১. কঠোর ঋণ পুনরুদ্ধার কৌশল: বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব ব্যাংককে একটি কঠোর ও কার্যকর ঋণ পুনরুদ্ধার কৌশল তৈরি করতে হবে। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে বিশেষ দল গঠন করে এবং অনাদায়ী ঋণ আদায়ে দ্রুত ও টেকসই আইনি প্রক্রিয়া কার্যক্রম দ্রুততর করা যেতে পারে।  
২. তারল্য সংকটের জন্য আলাদা ফান্ড: সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে তারল্য সংকট মোকাবিলায় একটি বিশেষ ফান্ড তৈরি করতে পারে, যা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা প্রদান করবে। তবে এই সহায়তায় যেন পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বিঘ্নিত না হয়।
৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও গ্রাহকদের আস্থা অর্জন: ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই তাদের গ্রাহকদের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। জনগণকে বোঝানো জরুরি– ব্যাংকগুলো দায়িত্বশীলভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে তাদের নিজস্ব ইমেজ বৃদ্ধির জন্য কাজ করাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। 
৪. এসএমই খাতের বিশেষ ঋণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া: এসএমই খাতে বিশেষ ঋণ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি চালু করা উচিত, যাতে এসএমই উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
৫. আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ গ্রহণ: প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংককে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করা যায় কিনা, সেই চেষ্টাও করা যেতে পারে। 
সবশেষে আবারও বলছি, তারল্য সংকট কাটাতে গিয়ে ঋণ পুনরুদ্ধারে মনোযোগ হারালে শ্রেণিভুক্ত ঋণের বোঝা আরও বাড়বে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়বে।

সাইফুল হোসেন: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট; ইউটিউবার, সিইও, 
ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল

আরও পড়ুন

×