‘কপ২৯’ শেষে আমরা কী ভাবছি?

এম. এ. হালিম
এম. এ. হালিম
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৮
অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে জার্মানিতে প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে কভিড ১৯-এর কারণে ২০২০ সাল ব্যতীত প্রতিবছর কপ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আজারবাইজানের বাকুতে কপের ২৯তম আসর শেষ হলো গত ২৩ নভেম্বর। এর অগ্রাধিকার ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করা। ফলে এবারের কপ অঘোষিতভাবে ‘ফাইন্যান্স কপ’ হিসেবে ফোকাস পায়। চরম উত্তেজনা, দরকষাকষি, ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটস (এওএসআইএস) এবং স্বল্পোন্নত দেশের জোট এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর ওয়াকআউট এবং নানা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন ডলার তহবিলের প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে বাকু কপ শেষ হলো।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট জি৭৭-এর কাছে এলডিসি জোটভুক্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রভাব মোকাবিলায় বার্ষিক ১.৩ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি চাওয়া হয়েছিল। একই সময়ে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি২০ থেকেও কোনো বিশেষ বার্তা বা অঙ্গীকার না পাওয়ায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ হাজার কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি নিয়েই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বাকু ত্যাগ করেন।
প্রতিবছর কপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন বার্তা ও প্রতিশ্রুতি রেখে যায়। তবে কপ২৯-এর অর্জন অর্থাৎ আর্থিক প্রতিশ্রুতি অতীতের তুলনায় বড় বলতে হবে। একই সঙ্গে সন্দেহ জাগে, এই অর্থ কত দ্রুত ও সহজে অভীষ্ট দেশগুলোর কাছে পৌঁছাবে এবং তার যথার্থ ব্যবহার কতটা নিশ্চিত হবে? কারণ প্যারিস এগ্রিমেন্ট অনুসারে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য স্বস্তিকর নয়। তাই কপ২৯-এর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্যও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ বিশ্বের ৮০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিলসহ অনেক দেশ নির্লিপ্ত। প্রতিটি কপ আয়োজনে বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। কিন্তু যাদের জন্য এই মহা আয়োজন, অর্থাৎ দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জলবায়ু ভুক্তভোগীদের কাছে এর বার্তা ও প্রতিশ্রুত অর্থ কতটা পৌঁছায়– তা বড় প্রশ্ন। কপ১৬ (দোহা ২০১৬) ও কপ২৮ (দুবাই ২০২৩)-এ আমার অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা এবং কপ নিয়ে বিশ্লেষণে মনে হয়েছে, প্রতিবছর এই মহা আয়োজন কতটা কার্যকর? কারণ এ ধরনের সম্মেলনে প্রধান ভেন্যুতে প্রতিদিন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র/সরকারপ্রধান অথবা মন্ত্রীদের ধারাবাহিক বক্তব্য উপস্থাপন ছাড়াও থাকে দরকষাকষি ও আক্ষরিক অর্থেই শত শত ইভেন্ট। দুই সপ্তাহের আলোচনা, সিদ্ধান্ত/ সুপারিশ ও অঙ্গীকার সংকলন (কমপাইলেশন) প্রকাশ করা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত ফলোআপ কার্যক্রম সংকলন ও পরবর্তী কপে তা উপস্থাপন, একই সঙ্গে পরবর্তী কপ আয়োজনের প্রস্তুতি কতটা বাস্তবসম্মত, সে বিষয়টি প্রশ্নযোগ্য।
জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে ১৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এলডিসি দেশগুলোর উচ্চ পর্যায়ের সভায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন, প্রতিবছর জলবায়ু সম্মেলন করা উচিত নয়। কারণ এটা সময়সাপেক্ষ, অপচয় ও অপমানজনক। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের কী প্রয়োজন, তা আমরা জানি। এ জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা উচিত।’ এখন দেখা যাক, জাতিসংঘ এ বিষয়ে ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নেয়, যদিও আগামী কপ (কপ৩০) ব্রাজিলে অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একটি জাতীয় ইভেন্টের কার্যক্রম, সুপারিশ-সংবলিত রিপোর্ট তৈরি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। কপ২৮ (দুবাই, ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর ২০২৩)-এর রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে চার মাস পর এ বছরের মার্চে। সুতরাং প্রশ্ন আসতেই পারে, অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাষ্ট্র, অংশীজন, ব্যক্তি রিপোর্টের সুপারিশ বছরের অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? তাই প্রতিবছর কপ আয়োজন না করে এক বছর অন্তর করা যায় কিনা? কপ ছাড়াও জাতিসংঘের আয়োজনে প্রতিবছর এক বা একাধিক দুর্যোগবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেমন অক্টোবরে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত হলো এশিয়া-প্যাসিফিক কনফারেন্স অন ডিআরআর। আগামী বছর জুনে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হবে গ্লোবাল ফোরাম অন ডিআরআর। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থাও দুর্যোগ ও জলবায়ু বিষয়ে প্রায়ই আন্তর্জাতিক ফোরামের আয়োজন করে। এসব ফোরামে সমকালীন ‘হটকেক’ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ও গুরুত্ব পায়।
যা হোক, বাংলাদেশের জন্য এখন লক্ষ্য হবে অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে প্রতিশ্রুত অর্থ থেকে ঋণ নয়, অনুদান হিসেবে প্রাপ্তি, দক্ষ কর্মপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা ১৯ নভেম্বর কপ সম্মেলনে এক আলোচনায় বলেছেন, অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতিবছর ৮.৫ বিলিয়ন ডলার দরকার। জানা যায়, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৭১০ মিলিয়ন ডলার তহবিল পেয়েছে (সমকাল ১২ নভেম্বর)। কিন্তু কৌতূহল জাগে, সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমে সমন্বিত অর্থপ্রাপ্তি কতটা দক্ষভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে অথবা সে তহবিলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কতটা নিশ্চিত হচ্ছে?
অতীতে দেখেছি, জলবায়ু তহবিল দিয়ে রাজধানীর ফুট ওভারব্রিজে টবে গাছ লাগানো অথবা শহরে ড্রেন নির্মাণ ও সংস্কারে ব্যয় করা হচ্ছে! নিজেরও অনেক সময় মনে হতো, জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় এমন বিভিন্ন সংস্থা অনেক অনেক কার্যক্রম করছে, যা ডিআরআর কাজের আওতায় চলমান। তাই প্রয়োজন কার্যকর সমন্বয় ও প্রাপ্ত তহবিলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। আরও দরকার আমাদের কৌশলপত্র, পরিকল্পনা ইত্যাদি হালনাগাদ করা। এসব উদ্যোগে বিশ্বের অনেক দেশের মতো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করতে হবে। তবে সর্বাগ্রে অভীষ্ট জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত করতে আমরা যেন ভুলে না যাই।
এম. এ. হালিম: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিকবিষয়ক বিশ্লেষক
- বিষয় :
- জলবায়ু পরিবর্তন