ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

পায়রা সমুদ্র বন্দর

রাজনৈতিক অভিলাষের প্রকল্প সুফল দেয় না

রাজনৈতিক অভিলাষের প্রকল্প সুফল দেয় না

মইনুল ইসলাম

মইনুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৭ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৮

গত ২৭ নভেম্বর একাধিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, দ্রুত পলি পড়ে পায়রা নদের রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্য কমে গেছে; তাই বড় জাহাজকে বহির্নোঙরে নোঙর করতে হচ্ছে। সেখান থেকে লাইটারেজে (ছোট জাহাজ) পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আনতে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। অথচ গত ৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক বণিক বার্তার এক খবর অনুসারে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ১৪ আগস্ট সমাপ্ত ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ওই চ্যানেলের গভীরতা ১০.৫ মিটারে উন্নীত করা হয়েছে। 

এ খবর পড়তে গিয়ে দেশের নেতৃস্থানীয় প্রকৌশলী প্রফেসর আইনুন নিশাতের কথা মনে পড়ল; তাঁর মতে, পায়রা নদের যে বিপুল পলিবহন প্রবণতা রয়েছে, সেটা বিবেচনায় নিলে প্রতিবছর রাবনাবাদ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রয়োজন হবে, নয়তো পায়রা সমুদ্রবন্দর থাকবে না, একটি নদীবন্দরে পরিণত হয়ে যাবে। তিনি বলেছিলেন, কোনো বন্দর-চ্যানেলের কমপক্ষে সাড়ে আট মিটার গভীরতা না থাকলে ওই চ্যানেলে কোনো সমুদ্রগামী জাহাজ প্রবেশ করে না। কিন্তু বণিক বার্তার ওই প্রতিবেদন বলেছে, ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পটি শেষ হওয়ার মাত্র এক মাসের মধ্যেই পলি পড়ে গভীরতা আবার সাত মিটারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক মাস না পেরোতেই সাড়ে তিন মিটার গভীরতা হ্রাস পেয়েছে চ্যানেলটির।

২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলো পায়রা বন্দরের নৌপথের পলির বিপদ সম্পর্কে জার্মানির বিশ্বখ্যাত ভূতাত্ত্বিক প্রফেসর হারম্যান কুদরাসের নেতৃত্বাধীন পাঁচজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান গবেষকের তৈরি একটি গবেষণা প্রতিবেদনের বক্তব্য প্রকাশ করে। গবেষণা প্রতিবেদনটি একই বছরের ১১-১২ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত হয়েছিল। প্রফেসর কুদরাস ২০ বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের পলি ও পানিপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন। ২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল’জ অব দ্য সিজ (ইটলস) এবং হল্যান্ডের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে বিজয় অর্জন করেছিল। ওই মামলাগুলোতে বাংলাদেশের দু’জন পরামর্শকের অন্যতম ছিলেন প্রফেসর কুদরাস। তাঁর টিমের পায়রা বন্দর সম্পর্কিত গবেষণার মূল বক্তব্য ছিল– বিশ্বের যতগুলো উপকূলীয় এলাকা আছে, তার মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রা এলাকায় সবচেয়ে বেশি পলি জমা হয়। পায়রা নদের ওই চ্যানেল দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ কোটি কিউবিক মিটার পলি প্রবাহিত হওয়ায় জোয়ার-ভাটায় এক বছরের মধ্যেই বারবার চ্যানেলটি ভরাট হয়ে যাবে। একবার ভরাট হলে খনন করতে ৮-১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যে ব্যয় নিয়মিতভাবে বহন করা যে কোনো দেশের জন্যই বিশাল বোঝা। 

কিন্তু এসব হুঁশিয়ারিকে পাত্তা না দিয়ে পটুয়াখালীতে পায়রাবন্দর গড়ে তোলার কাজ জোরদার করা হলো; এর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ফান্ড থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হলো। বলা হলো, ভারতের সেভেন সিস্টার্সের জন্য সেগুলো খুলে দিয়ে পায়রা বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এমনকি এ রকমও বলা হয়েছে, পায়রা বন্দর আঞ্চলিক গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজন মেটাবে; যদিও আগেই বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ মত এমন ভাবনার কার্যকারিতা সমর্থন করে না।

বিগত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার নিজস্ব রাজনীতির প্রয়োজনে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর প্রতি তাঁর একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। মূলত সে কারণেই পায়রা বন্দরটি দ্রুতগতিতে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল দৈনিক সমকাল ও দৈনিক আজাদীতে আমার প্রকাশিত কলামে বন্দর বিশেষজ্ঞদের মতো আমিও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, প্রকল্পটি অচিরেই একটি শ্বেতহস্তী হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু হাসিনা সরকার সেটিকে পাত্তাই দেয়নি। শেখ হাসিনার জেদাজেদি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড়সড় আর্থিক বোঝাই ডেকে আনল। পায়রা বন্দর আবারও প্রমাণ করল, রাজনৈতিক অভিলাষের প্রকল্প কখনও সুফল দেয় না।

আমার দুঃখ হচ্ছে, সাড়ে পাঁচ বছর আগে আমি যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলাম, সেটিই এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু পায়রা বন্দরের উন্নয়ন এবং রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য ইতোমধ্যে যে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হয়ে গেছে, সেটি তো স্রেফ অপচয় হয়ে গেল! দেশ তো এই বন্দর থেকে ভবিষ্যতে কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ফায়দা পাবে না। ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোকে যুক্ত করার গল্পটিও ফাঁপা বলে প্রমাণিত হলো। 

পায়রা বন্দর প্রকল্পটি যে যথাযথ ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়া গৃহীত হয়েছে, তা বুঝতে নিশ্চয়ই বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। একটি মেগা প্রকল্প নিয়ে এমন আনাড়িপনার কোনো অর্থও থাকতে পারে না। আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, পায়রা বন্দরকে গড়ে তোলার জন্য শুধু দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৫০ কোটি ডলার অপচয় করা হয়নি, চট্টগ্রাম বন্দরের ফান্ড থেকেও ৫০০ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে পায়রা বন্দরকে দাঁড় করানোর খায়েশ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পকে অবহেলা করে শেখ হাসিনা পায়রা বন্দর নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। বিশেষজ্ঞ মত হলো, যথাযথ অগ্রাধিকার পেলে এতদিনে বে-টার্মিনাল নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে চালু হয়ে যেত। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের ৯ নটিক্যাল মাইল চ্যানেলের গভীরতাকে আধুনিক ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সাড়ে ৯ মিটার থেকে সাড়ে ১০ মিটারে উন্নীত করাও ব্যয়সাশ্রয়ী হতো।  

মনে রাখতে হবে এসব খামখেয়ালি এমন সময়ে চলেছে যখন বিশেষত ডলার সংকটে অর্থনীতি বেহাল হতে শুরু করে। সেই বেহাল কিন্তু এখনও বন্ধ হয়নি, যার প্রতিপালন ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি। আর এর কাফফারা দিয়ে চলেছে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা হলো, এই শ্বেতহস্তী পোষা বন্ধের উপায় বের করা, না হলে অর্থনীতির রক্তক্ষরণও থামানো যাবে না। একইসঙ্গে আরও যেসব প্রকল্পে বিগত সরকারের খামখেয়ালিপনা ছিল সেগুলোও খুঁজে বের করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। 

মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×