তাবলিগ
ফেরকা ছেড়ে ভ্রাতৃত্বে ফিরুক ইজতেমা

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৫
দিল্লির মেওয়াত এলাকার বিভ্রান্ত মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গত শতকের বিশ দশকের দিকে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভির (রা.) প্রচেষ্টায় চালু হয় তাবলিগ জামাত। সৃষ্টির শত বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই এতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। সেই গৌরবের অংশীদার হয় বাংলাদেশ। টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে জমায়েত হয় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। পবিত্র হজ ছাড়া এত বড় মুসলিম সমাবেশ আর কোথাও হয় না। দীর্ঘ সময় ধরে এই তাবলিগ জামাতের দাওয়াত বিশেষ করে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির অনন্য উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়।
ইসলাম চর্চায় নতুন সংযোজন তাবলিগের পথচলাটা কয়েকবারই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জন্মের দুই যুগ পেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রথম পরিবর্তন আসে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাবলিগ জামাতের মার্কাজ দিল্লি থাকবে কিনা– এ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। মুরুব্বিদের সিদ্ধান্ত আসে মূল মার্কাজ দিল্লিতে থাকবে, আরেকটি মার্কাজ হবে পাকিস্তানে। সেই অনুযায়ী পাকিস্তানের করাচির রায়বেন্ডে পৃথক মার্কাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মূল মার্কাজ থেকে যায় ভারতেই। তখন প্রয়োজনের নিরিখে ঢাকার কাকরাইলেও আরেকটি মার্কাজ প্রতিষ্ঠা হয়। পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ এই তিন দেশের মার্কাজের মাধ্যমে তাবলিগের মুরব্বিদের নেতৃত্বে ইসলামের সেবা চলতে থাকে। তবে তখন সবকিছুই যে মসৃণভাবে চলেছে তা বলা যাবে না। ফতোয়া নিয়ে কারও কারও ভিন্নমত দেখা গেছে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ইসলামের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন নয়। আবার ইসলামের পথেই সেগুলোর সমাধানও হয়েছে সুন্দরভাবে।
এমন একটি সুন্দর প্রয়াসে বিঘ্ন ঘটে ২০১৭ সালে। তাবলিগ জামাতের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে তৈরি হয় মতভেদ। অত্যন্ত দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, এই মতভেদ কয়েক বছর ধরে পথভেদও তৈরি করে। দুই ভাগ হয়ে যায় তাবলিগ জামাত। পৃথক আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। একসময় ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থি পথ অবলম্বন করে বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সহিংসতা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটে যায়। দিল্লির মাওলানা সাদ ২০১৮ সালে বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিমানবন্দরে এসেও ইজতেমায় অংশ নিতে পারেননি সেই বিভেদের জের ধরে। ঢাকার সব মাদ্রাসার ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে জুতা মিছিল করে। বিমানবন্দর ঘেরাও করে হেফাজতি আলেম ও ছাত্ররা। এর পরের বছর দু’পক্ষ টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। সর্বশেষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটল বুধবার টঙ্গী ইজতেমা মাঠে। সাদপন্থি ও জোবায়েরপন্থিদের মধ্যে সহিংসতায় চার মুসল্লিকে প্রাণ হারাতে হয় এই সময়।
আরও দুর্ভাগ্যজনক, এই বিভেদ ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে বিভাজনের পর থেকেই। বিভেদটা বাবা-ছেলে এমনকি ভাইয়ে ভাইয়েও সৃষ্টি হয়।
দুই পক্ষের দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা ছিল এবং আছে। কিন্তু তাবলিগ জামাত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয় এবং তাদের আকিদাও রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। তাই হয়তো সরকারও কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই দুটি পক্ষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিকে নজর দিয়েছে। উদ্দেশ্য, অহেতুক সংঘাত যেন না ঘটে। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের সদিচ্ছার বাস্তবায়ন হয়নি তাবলিগ জামাতেরই কারণে।
বুধবারের ঘটনার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে, মাঠ দখল করা। দুই পক্ষই চায় ইজতেমার মাঠটি তাদের দখলে থাক। মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে ভিসা দেওয়ার প্রশ্নেও দুই গ্রুপে বিস্তর মতপার্থক্য। উভয় গ্রুপই তাদের নিজ অবস্থানে অনড় এবং এতটাই শক্ত অবস্থান তাদের যে, আগামী ইজতেমা অনুষ্ঠানে ভাবগাম্ভীর্য কতটা বজায় থাকবে তাও সন্দেহমুক্ত নয়। এমনও কেউ কেউ ভাবতে শুরু করেছেন যে, আদৌ ইজতেমা হবে তো?
এই সুযোগে তাবলিগবিরোধীরা ইজতেমা নিষিদ্ধেরও দাবি জানিয়ে বসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষিদ্ধের দাবির পক্ষে বলা হচ্ছে, যে ইজতেমায় রক্ত ঝরে তার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ। উভয়পক্ষই প্রথম দফায় তাদের সমাবেশ ঘটাতে চায়, এমন পরিস্থিতিতে ইজতেমাকে ঘিরে নিরাপত্তাহীন অবস্থা তৈরি হতে পারে। নিরাপত্তাহীন অবস্থা তাবলিগ জামাতকে ছাড়িয়ে নিরীহ জনগণকেও ভোগাতে পারে।
তাবলিগ জামাতের প্রতি এখনও দেশের ভেতরে ও বাইরে বিশ্বাস ও সমর্থন অনেক। দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে এই বিশাল সমাবেশ নিয়ে কৌতূহল শুধু নয়, এর নিয়ামক শক্তি নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে। এমন ভ্রাতৃত্ববোধ, আল্লাহর প্রতি নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে সমর্পণের সম্মিলিত এত বড় প্রয়াস দুনিয়ায় হজ পালন ছাড়া আর কোনোটা আছে কিনা সন্দেহ আছে।
বলা হয়ে থাকে, মাওলানা সাদ কান্ধলভির কিছু ফতোয়াকে মুফতি জোবায়েরের অনুসারীরা মেনে নিতে পারেননি। কোনো ফতোয়া কিংবা সিদ্ধান্ত কারও পছন্দ না হতে পারে কিংবা সেই ফতোয়াটি তাঁর দৃষ্টিতে হয়তো ইসলামসম্মত নাও হতে পারে। কিন্তু এই মতপার্থক্য না মিটিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি কি তাবলিগ জামাতের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধের ঘাটতিই যে অনাকাঙ্ক্ষিত এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উভয় গ্রুপই মতপার্থক্য নিরসনে তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা নিতে পারত। সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে তাবলিগ নিষিদ্ধ হলেও অনেক দেশ তাবলিগ জামাতের সঙ্গে যুক্ত। এ দেশগুলোর মুরব্বিদের সহযোগিতায় ফয়সালার পথ খোঁজা যেত। হয়তো আল্লাহর রহমতে মতপার্থক্য নিরসন হয়েও যেত।
ইসলামের দাওয়াত ও তাবলিগ করতে হয় একে অন্যকে সম্মান দিয়ে। এই সম্মানবোধ যখন কমে আসে তখন আর তাকে ইসলামের দাওয়াত বলা যায় না। সব ধরনের ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে ফেলে আল্লাহর রাহে নেমে পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে জামাতের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাথীদের আপন ভাইয়ের মতো মনে করতে হবে। আর ফেরকা সৃষ্টি করে ইসলামের ক্ষতিই করা হয়। যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে ফয়সালা হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, বিশ্ব ইজতেমা একদিকে ধর্মচর্চা, অন্যদিকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াতেও কার্যকর।
মোস্তফা হোসেইন: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
- বিষয় :
- তাবলিগ জামাত