ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

নারীমুক্তি

চির প্রাসঙ্গিক ‘সুলতানার স্বপ্ন’ চির অধরা থেকে যাবে?

চির প্রাসঙ্গিক ‘সুলতানার স্বপ্ন’ চির অধরা থেকে যাবে?

ছবি-সংগৃহীত

মর্জিনা খাতুন

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ১১:০৪

নতুন করে উদযাপনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমাদের সামনে আসছে প্রায় সোয়া শতাব্দী আগে রচিত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ধ্রুপদি উপন্যাস ‘সুলতানার স্বপ্ন’। গত বছর মে মাসে ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় স্থান পেয়েছিল এটি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রচেষ্টায় মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কমিটি ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক’ বা মৌক্যাপের দশম সাধারণ সভায় ঘোষণাটি দেওয়া হয়। এর পর গত বছর বিভিন্ন সময়ে যেমন ঢাকায়, তেমনি বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের পায়রাবন্দে বিভিন্নভাবে এর উদযাপন হয়েছে। সর্বশেষ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের এই বিখ্যাত উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গত ডিসেম্বরে বিশেষ পর্বতাভিযানে গেছে পর্বতারোহীদের সংগঠন ‘অভিযাত্রী’। “সুলতানা’স ড্রিম আনবাউন্ড” বা ‘সুলতানার স্বপ্ন অবারিত’ স্লোগানে অভিযানটির নেতৃত্বে রয়েছেন দেশের প্রথম নারী এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদার।

ইউনেস্কোর স্বীকৃতিই প্রমাণ করে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ যুগোত্তীর্ণ ভাবনা। বাংলাদেশে আমরা যারা নারী আন্দোলন ও নারীমুক্তি নিয়ে ভাবছি, তাদের বিজ্ঞানমনস্ক মনন ও উন্নত সমাজ গড়ে তোলার জন্য এটি অত্যাবশ্যক পাঠ্য।

১৯০৫ সালে মাদ্রাজের ‘দি ইন্ডিয়ান লেডিস’ ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনির আদলে লেখা হয়েছিল, যা ১৯০৮ সালে কলকাতার এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড সন্স থেকে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে মতিচূর দ্বিতীয় খণ্ডে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে উপন্যাসটি যুক্ত করা হয়। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসটি অবলম্বনে ১৯৮০ সালে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে একটি নাটক মঞ্চায়িত হয়। এ ছাড়াও স্প্যানিশ চলচ্চিত্রকার ইসাবেল হারগুয়েরা একটি অ্যানিমেশন সিনেমা বানিয়েছেন। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন তাঁর জীবনসঙ্গী জিয়ানমার্কো সেরা। সিনেমাটির নাম দিয়েছেন, ‘এল সুয়েনিও দে লা সুলতানা’। 

শতবর্ষ আগে বেগম রোকেয়া ‘লেডি ল্যান্ড’ বা আদর্শ নারীস্থান কেমন হবে তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ভগিনী সারার সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে। আজ আমরা যারা আদর্শ শহর বা নারীর জন্য নিরাপদ কর্মস্থল বা আবাসের কথা বা স্বল্প পরিশ্রমে আধুনিক জীবনযাপনের কথা ভাবছি; ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসে সেই বিষয়গুলো সুনিপুণভাবে চিত্রিত রয়েছে। 

সামাজিক বিধি-ব্যবস্থা কীভাবে নারীর বিকাশের পথে বাধা, তার বর্ণনা দিয়ে বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘কেবল শারীরিক বল বেশি হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না।’ এর মাধ্যমে সেদিন রোকেয়া পুরুষের প্রভুত্ব অস্বীকার করেছেন। কিন্তু আজও কি আমরা সেখান থেকে মুক্ত হতে পেরেছি? বরং প্রভুত্ব আরও বেড়েছে। 

বেগম রোকেয়ার এ কল্পকাহিনিতে শহরের বাড়ি কেমন হবে উল্লেখ রয়েছে: বাগান, হাঁটার রাস্তা, আধুনিক রান্নাঘর। সর্বোপরি থাকবে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা। বিস্ময়কর লাগে, ১১৯ বছর আগে রোকেয়া ‘সৌরকর’ নিয়ে ভেবেছেন। অথচ আধুনিক বিশ্বে হাজারো গবেষণা করে এই সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার আমরা বাড়াতে পারছি না। অথচ নারীস্থানে কীভাবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে সহজে রান্না করা যায়, বিজ্ঞানচর্চা করা যায়, যুদ্ধ জয়ে ব্যবহার করা যায়, তারও সাবলীল বর্ণনা আছে। 

উপন্যাসটিতে রোকেয়া দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের শ্রমঘণ্টার উল্লেখ করেছেন। একজন নারী দক্ষ হলে ২ ঘণ্টায় যে কাজ করতে পারেন, সেই কাজ পুরুষ করতে গেলে কীভাবে ৮ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয় তার বর্ণনা তিনি নিখুঁতভাবে দিয়েছেন। দারিদ্র্য কীভাবে সমাজকে জরাজীর্ণ করে; ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে; বৈষম্যের সমাজে কেমন করে রোগের বিস্তার এবং মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সচ্ছল বা বৈষম্যমুক্ত নারীস্থান কীভাবে রোগ-ব্যাধি থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারে, তারও উল্লেখ করেছেন তিনি।

এই উপন্যাসে রোকেয়া স্বাভাবিকভাবেই নারীশিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করেছেন ২১ বছর। অথচ একুশ শতকে এসে আমরা বিয়ের বয়স কমিয়ে মেয়েদের জন্য ১৬ বছর করার কথা ভাবলাম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! রক্ষণশীল সমাজে সব বাধা উপেক্ষা করে বেগম রোকেয়া যে নারীস্থান চিত্রায়িত করেছিলেন; নারীমুক্তির আন্দোলনে আজও তা অবিস্মরণীয়। প্রশ্ন হচ্ছে, চির প্রাসঙ্গিক ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি চির অধরা থেকে যাবে? 

মর্জিনা খাতুন: নারী অধিকারকর্মী 

আরও পড়ুন

×