প্রতিক্রিয়া
প্রবীণের সম্মান ‘কুলবাড়িয়া’ মডেল

.
মো. আবু সাঈদ
প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৫ | ০০:২২
পিতা-মাতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির জন্য তাদের মারধর বা ভাত-কাপড় না দেওয়ার খবর পত্রিকার পাতায় আসে প্রায়ই। হৃদয়বিদারক ও নির্মম এমন বহু ঘটনা যেমন চোখ ভিজিয়ে দেয়, তেমনি মেহেরপুর সদরের কুতুবপুর ইউনিয়নের কুলবাড়িয়া গ্রামের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের ঘটনাটি বেশ আশা জাগায়। ১৬ ফেব্রুয়ারি সমকালে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা সংবাদটির শিরোনাম– সত্তরেও খুশি আর ধরে না। পরে মনে হলো যেন ঈদগাহ মাঠে বছরের একটি বোনাস ঈদ হয়েছে। নবীনদের আয়োজনে প্রবীণদের জন্য এমন ভালোবাসা সত্যিই বিরল।
প্রবীণদের পাশাপাশি সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহ আর অফুরান ভালোবাসা জানাই কুলবাড়িয়া গ্রামের সেই তরুণদের। যারা দৃষ্টান্ত হতে পারেন দেশের কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর কাছে। নিজের মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মানবোধ থেকেই অন্য বাবা-মাকে একটু শ্রদ্ধা জানানোর ধারণাটা অসাধারণ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু তুলনামূলক বেশি। আমাদের দেশে সরকারি হিসাবে ৬৫ বছরের বেশি মানুষ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে গণ্য। ২০২৪ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশর মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর। যেখানে ভারতের ৬৭ বছর, নেপালের ৬৭ বছর ও পাকিস্তানের ৬৬ বছর। অন্যদিকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গড় আয়ু নিয়ে মানুষ বাঁচে মোনাকোয়। তাদের গড় আয়ু প্রায় ৯৪ বছর। জাপানে ৮৪, সিঙ্গাপুরে ৮২, হংকংয়ে ৮২, অস্ট্রেলিয়ায় ৮৪ ও চীনে গড় আয়ু ৭৪ বছর।
দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে শতাধিক প্রবীণ নিবাস আছে। কিছু মহৎ মানুষের উদ্যোগে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও হয়েছে মেডিকেল সেবাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। কিন্তু কথা হলো, মেহেরপুরের তরুণরা যা করেছে তা কি নতুন মডেল হতে পারে না সারাদেশের জন্য? বছরের কোনো নির্দিষ্ট দিনে এক একটি এলাকার তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে হয়ে তাদের স্থানীয় প্রবীণদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাতে পারেন না? এখন কর্মক্ষেত্রে এসে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে শৈশবে ফেলে আসা স্কুলশিক্ষক, বাড়ির পাশের চায়ের দোকানি, স্কুলের সামনের চানাচুর বিক্রেতা, বাড়ির কাজের লোক বা প্রতিবেশী কাকা-কাকি, দাদা-দাদি যাদের বাগানের আম, লিচু বা কুলগাছে ঢিল দিয়েছেন এক সময়, তাদের জন্য বছরের একটি দিন হতে পারে না? আমাদের তারুণ্যের উত্তাল সাগরে তাদের জেঁকে ধরা বয়সের ভিড়কে একদিন হারিয়ে দিলে মন্দ হয় না তো। তাদের কাছ থেকে আগেভাগেই আমরা হয়তো এই জীবনের অভিজ্ঞতাও আগাম অর্জন করতে পারি, যা তারা পেছনে ফেলে এসেছেন।
পাশাপাশি সমাজ ও দেশের কল্যাণেই আমাদের প্রবীণদের দিকে এখনই আরও সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। শুধু বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাস নামের যন্ত্রণার সাগরে না ভাসিয়ে পরিবারের প্রবীণদের রাখতে হবে নিজের পরিবারের সঙ্গেই। মনে করুন, আপনার স্ত্রী বা স্বামী দু’জনই চাকরিজীবী। নিয়ম করে অফিসে যান এবং বাসায় ফেরেন। তখন আপনার সন্তান কিন্তু বেড়ে উঠছে কাজের লোকের কাছে। কিন্তু এই জায়গায় যদি আপনার বাবা-মা বাসায় থাকেন; দাদা-দাদি হিসেবে শিশুটি আপনজনকে পাশে পাবে। আপনার বাবা-মা আপনাকে যে শিক্ষা দিয়েছে, সেই পারিবারিক শিক্ষাগুলো আপনার সন্তানও পাবে। শহর বা কর্মক্ষেত্র থেকে আপনার গ্রাম যদি হয় নিরাপদ দূরত্বে তাহলে সন্তানকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্রামীণ পরিবেশেও রাখতে পারেন। যাতে সে দাদা-দাদি বা নানা-নানির কাছ থেকে পরিবারিক শিক্ষা পেল; ইট-কাঠের জঞ্জালের নগর ছেড়ে গ্রামকেও চিনল।
কুলবাড়িয়ায় তরুণ-যুবাদের আয়োজনে ‘মুরব্বিদের মিলনমেলা’ প্রবীণদের সম্মানের এক আয়োজন। সেখানে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার আলাপ হয় চেনাজনের সঙ্গে; অচেনা সমবয়সী মানুষের সঙ্গে আলাপ হয় সংসার-সংকটের। সেটাও তো কম প্রাপ্তি নয়। প্রবীণদের সম্মান জানিয়ে এমন আয়োজন ছড়িয়ে পড়ুক দেশের সর্বত্র।
মো. আবু সাঈদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
- বিষয় :
- প্রতিক্রিয়া