সমকালীন প্রসঙ্গ
জলে ডোবা ঢাকা

একটু বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। ছবি– লেখক
ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৫ | ২০:১৪ | আপডেট: ২২ মে ২০২৫ | ২১:২৮
বৃহস্পতিবার সকালের ঝুমবৃষ্টিতে ঢাকা নগরের বহু জায়গা তলিয়ে গেছে। জিগাতলা থেকে তেজগাঁও আসতে বেশ বেগই পেতে হলো। অতিরিক্ত সময়ের কথা নাইবা বললাম। ঢাকা নিয়ে দু’দিন আগে সমকাল অনলাইনেই লিখেছিলাম– ‘ঢাকা এক অবরুদ্ধ নগরের নাম’। আজ ঢাকার পরিস্থিতি নিজেই ‘জলে ডোবা’ নামটাই বেছে নিল।
নগর হিসেবে ঢাকা বেশ প্রাচীন। তবে ষোল শতকে এটি বিশেষত প্রশাসনিক কারণে পরিচিতি লাভ করে। আঠারো শতকের পর থেকে কলকাতার পাশাপাশি ঢাকার নামও উচ্চারিত হতো। বিশেষত ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকার ওপর মনোযোগ স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক তৎপরতা বিশেষত ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা সেই চিত্রই খুঁজে পাই।
ঢাকাকে কেন্দ্র করে একটি জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। মুক্তিযুদ্ধের পর যে রাজনৈতিক শ্রেণি ক্ষমতায় বসেছিল, তাদের কোনো ইতিবাচক জাতীয় প্রকল্প ছিল না। তার গুরুত্বপূর্ণ একটি নজির হলো মৃত্যুকূপ এই ঢাকা। বিশ্বে সবচেয়ে আবাসযোগ্য নগর, দূষিত বায়ুর তালিকায় ঢাকার নাম সবার ওপরে। মূলত গত ৫০ বছরে ক্ষমতাসীন দলগুলোর গৃহীত নীতির ফল হলো বর্তমান ঢাকা শহর। এখানে একমুঠো বিশুদ্ধ বাতাস কিংবা পানি পাওয়ার সুযোগ নেই। যে নগর বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখানকার বাসিন্দাদের এখন টাকা দিয়ে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হয়। ঢাকা যে ইতোমধ্যে মৃত নগরে পরিণত হয়েছে, তার প্রমাণ হিসেবে এর চেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত কি হতে পারে?
এভাবে বিশেষ একটি শহরকে নগরায়িত করার নেপথ্য কারণ হলো, এক ধরনের সিন্ডিকেটবাজি। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যেমন পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে রেখে ভোক্তাদের জিম্মি করে রাখে, তেমনি সব ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষ একটি নগরমুখী রেখে অন্যান্য অঞ্চল ও মানুষকে জিম্মি করে রাখা হয়। এতে বিশেষত লাভবান হয় নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী।
ঢাকার যানজট নিয়ে সম্প্রতি একটি তর্ক উঠেছে। এখানে বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এক পক্ষ মনে করে, অটোরিকশার চালকরা কেন ঢাকায় আসবেন, তাদের উচিত গ্রামে থেকে জীবিকা নির্বাহ করা। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই যুক্তি দেয় নগরবাসীর মধ্যে শিক্ষিত পেশাজীবীর একাংশ। কিন্তু তারা এটা চিন্তা করে না যে, ঢাকার বাইরে দিনমজুরদের জন্য আমরা যথেষ্ট অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত করিনি। দিনমজুররা সরকারি কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই অটোরিকশার মতো উদ্যোগ নিয়েছেন। অথচ আজ নীতিপ্রণেতারা কুযুক্তি দিয়ে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করছেন। অথচ তাদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা এবং অটোরিকশার যন্ত্রাংশ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে উঠছে না। মূল বার্তা হলো, নীতিপ্রণেতা এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত হর্তাকর্তারা স্রেফ নিজেদের সুযোগ-সুবিধাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায় তারাও পড়েছেন মহাবিপদে। সেই বিপদ থেকে রক্ষার জন্য আবারও ক্ষমতাসীন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর ছোবলটা পড়ছে। মূলত নগরায়ণ প্রকল্পে সাধারণ মানুষের কথা কখনও তোয়াক্কা করা হয়নি।
বর্তমানে ঢাকা শহরে এক কোটি দুই লাখের বেশি মানুষ বাস করে। এত জনবসতিপূর্ণ একটি শহর নিয়ে নীতিপ্রণেতাদের অবহেলা ও স্বার্থপরতা একে জলে ডোবা নগরে পরিণত করবে– এটিই স্বাভাবিক।
কিছু ছোট উদ্যোগ এখনও নগরটির চেহারা বদলে দিতে পারে। দখলকৃত নদীগুলো পুনরুদ্ধার করা, পার্কগুলো গড়ে তোলা, চারপাশে সবুজায়ন বৃদ্ধি করা এবং নীতি গ্রহণে বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে গুরুত্ব না দিয়ে সর্বস্তরের নগরবাসীকে বিবেচনায় নেওয়া। সর্বোপরি দরকার মফস্বল ও গ্রামগুলোতে আয়-রোজগার, চিকিৎসাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নাগরিকবান্ধব করে গড়ে তোলা। পুরোনো লুটেরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এইসব আকাঙ্ক্ষা কল্পনায়ই থেকে যাবে।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
[email protected]