অন্যদৃষ্টি
গাজায় ত্রাণের নামে গণহত্যা

প্রতীকী ছবি
বেলেন ফার্নান্দেজ
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫ | ০০:২৪ | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫ | ১১:১৬
মঙ্গলবার গাজার দক্ষিণ শহর রাফায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের পাশে ইসরায়েলি অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও কয়েক ডজন আহত হন। এই হামলা এমন সময়ে হয়েছে, যার দুই দিন আগে একই স্থানে ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের হামলার শিকার হন হাজারো উদ্বিগ্ন ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি। সেখানে প্রাণ হারান ৩১ ফিলিস্তিনি। একই দিনে মধ্য গাজার নেটজারিক মরিডোরের কাছে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে আরেকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গাজার ২০ লাখ অনাহারী মানুষকে এখন মাত্র চারটি স্থানে খাবার বিতরণ করা হয়। তারা প্রায় তিন মাস ইসরায়েলি এমন ব্লকেডের মধ্যে ছিলেন, যেখানে ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ১৯ মে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় ‘সীমিত’ ত্রাণ সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেন। তাও তখন এই অনুমতি আসে যখন গণঅনাহার পরিস্থিতি এমন ‘লাল রেখা’য় পৌঁছে, যার পর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সংকটে পড়তে পারে; বস্তুত ইসরায়েলি অপরাধ ও গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র।
এখনও এমন গণহত্যার কারণ হলো, ‘সীমিত’ পর্যায়ে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি, যার কারণে ফিলিস্তিনিরা এমন ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন, হয় ক্ষুধায় মারা যাবে, না-হয় খাবার না পাওয়ার জন্য মারা যাবে। শুধু এ দুই কারণে তারা মারা যাচ্ছে না। বরং ইসরায়েলি জেনোসাইডে যখন দেশটি নির্বিচারে হাসপাতাল, শরণার্থী শিবিরে এবং এর বাইরেও বোমা মারছে তখন ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৫৪ হাজার চার শতাধিক।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামে নতুন একটি সংগঠন পরিচালনা করে। এটি মূলত ইসরায়েলি উদ্ভাবিত বেসরকারি সংগঠন, যা সুইজারল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলওয়ার রাজ্যে নিবন্ধিত। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, জিএইচএফের ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য বিতরণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।’ অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, যেখানে সংগঠনটি সাবেক মার্কিন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে।
সে জন্যই গাজায় খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এখন সশস্ত্র মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদারদের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়, যেখানে এগুলোর অবস্থান ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি সুবিধাজনক জায়গায়। বর্তমানে যে চারটি জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়, সেগুলো মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় অবস্থিত। অথচ গাজার উল্লেখযোগ্য মানুষ বাস করে উত্তর দিকে। ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য অনেক ফিলিস্তিনিকে দীর্ঘ পথ হেঁটে ইসরায়েলি সামরিক সীমানা অতিক্রম করে যেতে হয়, যা তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে। সেখানে বয়স্ক, অসুস্থ বা আহত ফিলিস্তিনিদের খাবার বিতরণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। আর শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম, যারা এতদূর যেতে পারেন না, এমন ক্ষুধার্ত মানুষের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
অধিকন্তু জিএইচএফের উদ্যোগ ইসরায়েলের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করছে। তারা জীবিত ফিলিস্তিনিদের গাজার দক্ষিণাঞ্চলে জড়ো করার চেষ্টা করছে, যাতে পরে তাদের স্থায়ীভাবে বিতাড়ন সহজ হয়। এটি করা হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত নতুন গাজা পরিকল্পনা অনুসারে, যে পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি ব্যতীত অন্যদের নিয়ে অঞ্চল গড়ার লক্ষ্য রয়েছে। অন্যভাবে বললে, জিএইচএফ গাজার মানুষের ক্ষুধা নিবারণ বা স্থানীয়দের চাহিদা পূরণে কাজ করছে না; বরং তাদের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এমন এক চমকপ্রদ প্রচারণার আয়োজন, যা মানবিক বিপর্যয়ের নামে ইচ্ছাকৃত অনাহার ও গণহত্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তাকারী সংস্থা মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কড়া সমালোচনা করেছে। এমনকি এই পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, জিএইচএফের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক মার্কিন মেরিন স্নাইপার জেক উড পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বেলেন ফার্নান্দেজ: আলজাজিরার কলাম লেখক; ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর
মাহফুজুর রহমান মানিক
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- ইসরায়েলি গণহত্যা