হজ
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক

ছবি: ফাইল
মো. শাহজাহান কবীর
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫ | ০২:০৮
হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভই নয়; মুসলিম উম্মার সবচেয়ে বড় সম্মিলনও বটে। সারাবিশ্বের মুসলমান পবিত্র জিলহজ মাসে বায়তুল্লাহ জিয়ারতের জন্য মক্কায় মিলিত হন। হজের মাধ্যমে উপস্থিত হাজিরা বিশ্ববাসীকে এই বার্তা দেন– বিশ্বের সব মুসলমান এক জাতি। তাই তারা সাদা হোক বা কালো, ধনী কিংবা গরিব; তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। তারা সবাই মহান আল্লাহর বান্দা।
৯ জিলহজ পবিত্র মক্কা নগরীর আরাফার ময়দান সারাবিশ্ব থেকে আসা মুসলমানের লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত হয়। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। অর্থাৎ হাজিরা বলছেন– হে আল্লাহ, আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির; তোমার কোনো শরিক নেই। এদিন আরাফার ময়দানে অবস্থান এবং খুতবা হজের প্রধান আয়োজন।
হজ ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহপাকের নির্দেশে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তারা একে অন্যকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তারা সুদীর্ঘকাল পর আরাফার ময়দানে মিলিত হন। আদম (আ.)-এর পর হজরত নুহ (আ.)সহ অন্য নবী-রাসুলরাও বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও তাওয়াফ করেছেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, বায়তুল্লাহ শরিফ পুনর্নির্মাণ কাজ সমাধা করার পর হজরত জিবরাইল (আ.) হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে এই পবিত্র গৃহ তাওয়াফ ও হজ করার জন্য বললেন। এ নির্দেশ পেয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) উভয়েই তাওয়াফসহ হজের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমাধা করলেন। এর পর আল্লাহতায়ালা হুকুম করলেন, হে ইবরাহিম, তুমি সমগ্র পৃথিবীর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা ছড়িয়ে দাও। এই মর্মে কোরআন মজিদের সুরা হজের ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দিন; তারা আপনার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে। তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে।’ তখন হজরত ইবরাহিম (আ.) একটি উঁচু স্থানে আরোহণ করলেন এবং ডানে-বামে পূর্ব-পশ্চিমে ফিরে হজের ঘোষণা করে বললেন– ‘হে লোক সকল! বায়তুল্লাহ শরিফের হজ তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দাও।’ এ আহ্বান শুনে পূর্ব দিগন্ত থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত যাদের হজ নসিব হবে তারা সবাই লাব্বাইক বলেছে। কেউ সাড়া দিয়েছে একবার; কেউ সাড়া দিয়েছে একাধিকবার।
হজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। প্রত্যেক সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শারীরিক, মানসিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলিম নর-নারীর ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এর পর যতবার হজ পালন করবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। নফল হজেও অনেক সওয়াব রয়েছে।
হজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা আল ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর উদ্দেশে বায়তুল্লাহ শরিফে হজ পালন করা মানুষের ওপর অবশ্য কর্তব্য, যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে।’
হজ এমন একটি মিলনমেলা, যা প্রত্যেক হাজিকে লাখো মুসলিমের সঙ্গে পরিচয়ের বিরাট সুযোগ করে দেয়। ইসলামের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় করতে হজের ভূমিকা অপরিসীম। হজ মানুষের অতীত জীবনের গুনাহ ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়।
হাদিস শরিফে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পানি যেমন ময়লা ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়, হজও তেমনি গুনাহগুলোকে ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়’ (সহিহ বুখারি)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশে হজ আদায় করল, তারপর কোনো অশ্লীল কাজ করল না, পাপ কাজ করল না, সে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরল’ (বুখারি ও মুসলিম)।
সবার প্রভু এক। এক নবীর উম্মত। সবার জীবন বিধান কোরআন এক। সবার কেবলা, সবার ইমাম, সবার রুকু-সেজদা, সবার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। এভাবেই আগত লাখ লাখ জনতার দেশীয় ভাষা, আঞ্চলিক জাতিসত্তা, দেশ, বংশগোত্র ও বর্ণের কৃত্রিম বৈষম্যচূর্ণ-বিচূর্ণ করে একাকার হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বিশ্বমুসলিম উম্মাহর এক অপ্রতিরোধ্য সিসা ঢালা প্রাচীর নির্মিত হয় হজে। তাই এই সময়ে বিশ্বশান্তি স্থাপনে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ মিটিয়ে; লড়াই-সংগ্রামের পরিবর্তে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব গ্রহণ করা যায়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় রাখা যায় বলিষ্ঠ অবদান। মহান আল্লাহ সব হাজির হজ কবুল করে বিশ্বমুসলিমের ঐক্য সুদৃঢ় করার তৌফিক দান করুন।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
- বিষয় :
- মহানবী (সা.)