ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ফিলিস্তিন

গাজার মুক্তিতে বিশ্বের দায় এবং ম্যাডলিন জাহাজ

গাজার মুক্তিতে বিশ্বের দায় এবং ম্যাডলিন জাহাজ

ছবি: সংগৃহীত

ইয়ারা হাওয়ারি

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫ | ০৪:৫১

ফিলিস্তিনের গাজা উপকূলের কাছে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ৯ জুন ম্যাডলিন জাহাজকে আটকে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। জাহাজটিতে গ্রেটা থুনবার্গসহ সাতটি দেশের ১২ জন অ্যাক্টিভিস্ট মানবিক ও খাদ্য সহায়তা নিয়ে আসছিলেন। জাহাজটিতে ত্রাণ সহায়তা কতটা ছিল, তা বড় বিষয় নয়।

ফিলিস্তিনের ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর জন্য সে সহায়তা হয়তো খুব বেশি উপকারও করতে পারত না। কারণ জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, গাজাবাসীর মৌলিক চাহিদা পূরণে সেখানে প্রতিদিন ৫০০ ট্রাক ত্রাণ সহায়তা দরকার। তারপরও ম্যাডলিন জাহাজটি গাজায় পৌঁছার আগেই যে ইসরায়েলি বাহিনী থামিয়ে দেবে– তা হয়তো অনুমিতই ছিল।  

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ম্যাডলিন জাহাজটি একটি মিশন সামনে নিয়ে চলছিল। এটি বিশ্ববাসী ও সরকারগুলোকে দেখাতে সক্ষম হয়– তারা এক চরম সত্যকে অস্বীকার করছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গাজার গণহত্যা বন্ধ এবং গাজাকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করা তাদের দায়িত্ব ছিল, যা পালনে তাদের ব্যর্থতা ভোলার নয়। 

এই ম্যাডলিন জাহাজটি ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) আয়োজনে চলছিল, যে গ্রুপটি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে ক্যাম্পেইন করছে। মে মাসে তাদের আরও নৌযান মাল্টার জলসীমার বাইরে ড্রোন হামলার শিকার হয়। ওই সময় তারা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গাজা সফর অব্যাহত রাখতে পারেনি। বলাবাহুল্য, এফএফসি গাজা অবরোধ তুলে দেওয়ার জন্য দেড় দশক ধরে আন্দোলন করে আসছে। ২০১০ সালে তুরস্ক থেকে ছয়টি জাহাজের একটি বহর গাজা উপত্যকার উদ্দেশে রওনা দেয়। সেগুলোকেও ইসরায়েলি সেনারা আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাহাজ মাভি মারমারায় ইসরায়েলি কমান্ডোরা হামলা চালায়। তারা গুলি করে ৯ জন মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিককে হত্যা করে; সবাই ছিলেন তুরস্কের নাগরিক। এখন পর্যন্ত সেই হত্যাযজ্ঞের বিচার হয়নি।

সে ঘটনায় নোয়াম চমস্কি লিখেছিলেন: ‘দশকের পর দশক ধরে সাইপ্রাস ও লেবাননের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক জলসীমায় নৌকা ছিনতাই করে আসছে ইসরায়েল। যাত্রীদের হত্যা, অপহরণ এবং কখনও তাদের ইসরায়েলি কারাগারে নিয়ে যায়। এমনকি গোপন নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। আবার কখনও তাদের দীর্ঘদিন জিম্মি করে রাখে। ইসরায়েল মনে করে, এসব অপরাধ তারা নিরাপদেই চালিয়ে যেতে পারে। তাদের শাস্তি হয় না, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এসব প্রশ্রয় দেয় এবং ইউরোপ সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে থাকে।’

মাভি মারমারা ও ম্যাডলিন উভয় জাহাজকেই যেভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে; আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তা অন্যায়। আন্তর্জাতিক জলসীমায় আন্তর্জাতিক অ্যাক্টিভিস্টদের আটক করার অধিকার ইসরায়েলের নেই। ফিলিস্তিনি-আমেরিকান আইনজীবী ও এফএফসির সংগঠক হুয়াইদা আরাফ বলেন, ‘এসব স্বেচ্ছাসেবক ইসরায়েলি আইনের এখতিয়ারে নয় এবং ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া কিংবা অবৈধ অবরোধকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাদের অপরাধী করতে পারে না। তাদের আটক করা বিধিবহির্ভূত, অন্যায়। অনতিবিলম্বে তাদের ছেড়ে দিতে হবে।’ (ইতোমধ্যে অবশ্য তাদের চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।)   

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, যখন কোথাও জেনোসাইডের মতো ভয়ানক অপরাধ সংঘটিত হয় তখন জাতিসংঘ সদস্যদের তা থামাতে ভূমিকা রাখা উচিত। তাদের দায়িত্ব হলো, অবরোধ আরোপ করা এবং অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া। অথচ তার পরিবর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ সদস্য দেশ, ম্যাডলিন জাহাজের অধিকাংশ সদস্যই সেসব দেশের; আন্তর্জাতিক এই আইন তো মানছেই না, উপরন্তু ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। যদিও ইউরোপীয় জনগণের একটি বড় অংশ এই অস্ত্র রপ্তানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। 

ম্যাডলিন জাহাজের কর্মীরা জানতেন, তারা হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য তথা গাজায় পৌঁছাতে পারবেন না। তবুও তারা এই বিপজ্জনক মিশনে অংশ নিয়েছিলেন, যাতে বিশ্বকে গাজা অবরোধ ও তাদের সরকারের নিষ্ক্রিয়তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। গ্রেটা থুনবার্গ বলেন, ‘আমরা এটি করছি কারণ যত বাধাই আসুক, আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ আমরা চেষ্টা থামালেই আমাদের মানবতা হারিয়ে যাবে।’ 

ম্যাডলিন সমুদ্রে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে গেলেও এর বার্তা স্পষ্ট: অবরোধ অদৃশ্য নয় এবং এটি চিরস্থায়ীও নয়। প্রতিটি আটকানো জাহাজ, প্রত্যেক গ্রেপ্তারকৃত কর্মী, প্রতিটি প্রতিবাদ গাজার মুক্তির সংগ্রামে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করে। তার মানে, গাজাকে ভুলে থাকা যাবে না। যতক্ষণ মুক্তি না আসবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হবে, ততক্ষণ সমুদ্রও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামে সম্মুখসারির ভূমিকায় থাকবে।

ইয়ারা হাওয়ারি: ফিলিস্তিনি পলিসি নেটওয়ার্ক আল শাবাকার সহপরিচালক; আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন

×