ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

অর্থনীতি

কেমন যাবে নতুন অর্থবছর

কেমন যাবে নতুন অর্থবছর

হাসান মামুন

হাসান মামুন

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫ | ০০:৪০ | আপডেট: ৩০ জুন ২০২৫ | ০০:৪১

নতুন অর্থবছর শুরুর মুহূর্তে ভালো-মন্দ দু’রকম খবরই রয়েছে। সবচেয়ে ভালো খবর রিজার্ভ লাফিয়ে বাড়া। জুন শেষে মোট রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াচ্ছে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী এবং এ মুহূর্তে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ অবশ্য ৪-৫ বিলিয়ন ডলার করে কম হবে। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি স্বস্তির। বিগত সরকারের শেষ সময়টায় রিজার্ভ নিয়ে অস্বস্তি কাটছিলই না। তিন মাসের আমদানি বিল পরিশোধের মতো রিজার্ভ আছে কিনা– এমন প্রশ্ন উঠছিল থেকে থেকেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ১১ মাসে রিজার্ভে উন্নতি হয়েছে ক্রমে। এর একটা কারণ ক্রমে শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ। আরেকটা কারণ অবশ্য আমদানি কমে যাওয়া। এ অবস্থায় রিজার্ভ থেকে ডলার জোগাতে হচ্ছে না। অর্থবছরের শেষ সময়ে আবার বড় অঙ্কের বিদেশি অর্থ এসে যুক্ত হচ্ছে রিজার্ভে। এর মধ্যে আইএমএফ ঋণের দুই কিস্তি লাভের ঘটনা তাৎপর্যবহ। এটা না পেলে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী নতুন করে ঋণ জোগাতে দ্বিধাগ্রস্ত হতো। আইএমএফের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যদেরও দেখা যাচ্ছে ঋণ সহায়তায় এগিয়ে আসতে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটা ইতিবাচক পরিস্থিতি, বিশেষত যখন তাদের আরও বেশ ক’মাস দেশটি চালাতে হবে। 

খারাপ খবরের মধ্যে আছে বোরো উত্তোলন সম্পন্নের পরও চালের দাম বৃদ্ধির ঘটনা। উত্তোলন শুরুর পর এর দাম হ্রাসে মানুষ খুশি হয়েছিল। গত রমজানেও চালের বাজারে ছিল এক ধরনের অস্থিরতা। বিগত বছর থেকে চলে আসা ‘ঘাটতি’ হ্রাস এবং মজুত স্বস্তিকর করতে চাল আমদানিতে উদ্যোগী ছিল সরকার। কর-শুল্ক প্রায় শূন্য করে দেওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় প্রধান উৎপাদন মৌসুমের ফলন হাতে আসার পরও চালের দাম বাড়লে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। ধানের দাম বৃদ্ধির কারণে এমনটি ঘটলে সেটাকেও ইতিবাচক বলার সুযোগ কম। গরিব কৃষকের হাতে এ মুহূর্তে কতটা বিক্রয়যোগ্য ধান-চাল আছে, দেখতে হবে। অন্যান্য কারণের কথাই কিন্তু বেশি বলা হচ্ছে। যেমন ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে চালকল বন্ধ থাকা। চাল পরিবহনে জটিলতা আর ব্যয় বৃদ্ধির কারণও দেখানো হচ্ছে। দেশে ডিজেলের দাম অল্প হলেও কমেছে। এ অবস্থায় চাঁদাবাজি ছাড়া অন্য কোনো কারণে পরিবহন ব্যয় বাড়ার কথা নয়। কিছুদিন আগে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এক সভায় অভিযোগ করে বলছিলেন পণ্য পরিবহনে দস্যুতা বেড়ে যাওয়ার কথা। চালের বাজার অস্থির হওয়ার নেপথ্যে এসব কারণ আছে কিনা, কে জানে! 

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট শেখ হাসিনা সরকার দিলেও এর প্রায় পুরোটা বাস্তবায়ন করল ইউনূস সরকার। নতুন বাজেটও তাদের দিতে হলো। কাজটা সহজ ছিল না; প্রীতিকরও নয়। বিশেষত বিগত সরকারের রেখে যাওয়া পরিস্থিতিতে। সেটা নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন অবশ্য নেই। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নে গঠিত টাস্কফোর্স ও কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সেটা তুলে ধরেছে। এতে সংকটের স্বরূপ জানতে অসুবিধা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও তৎপর। তার প্রধান কাজ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। 

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে লুটপাট সবচেয়ে তীব্রভাবে হয় ব্যাংক খাতে। তাতে এক শ্রেণির ব্যাংক এখন বন্ধের পথে। সেগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ঘোষিত নীতি বদলে টাকা ছাপিয়ে তহবিল জোগাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যেও কিছু ব্যাংক আছে ইতিবাচক ধারায়। উল্লেখযোগ্য মুনাফা করা ব্যাংকও রয়েছে। ব্যাংক মুনাফা করা মানেই কিন্তু সেটা বেসরকারি খাতের সচলতার প্রমাণ নয়। ব্যাংক মুনাফা করেছে প্রধানত সরকারকে ঋণ জুগিয়ে। এর মানে আবার– সরকার বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীল থেকেছে, রাজস্ব আহরণ যেহেতু খারাপ। শেষদিকে একযোগে বড় অঙ্কের অর্থ পেলেও ইউনূস সরকার দীর্ঘদিন কিন্তু ছিল বিদেশি ঋণের খরায়। দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই চলতে হয়েছে তাকে। ব্যাংকও এটা জোগাতে পেরেছে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বেশি না থাকায়। 
বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়া মোটেও ভালো কথা নয়। এর মানে হলো, উৎপাদন খাত ঝিমিয়ে পড়া। এমনটি ঘটলে বিশেষত শিল্পের মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানি কমে যায়। বিদায়ী অর্থবছরজুড়ে এ ধারা অব্যাহত থাকায় স্বস্তি ছিল না অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায়। উৎপাদন না বাড়ার মানে কর্মসংস্থানে অবনতি। শ্রমবাজারে যোগদানকারীরা কাজ পাবে কীভাবে, কর্মে নিয়োজিতরা যখন কাজ হারায়! বিদায়ী অর্থবছরে এমন বেদনাদায়ক পরিস্থিতিই মোকাবিলা করতে হয়েছে জাতিকে। তার একটা বড় কারণ অবশ্য গণঅভ্যুত্থানে তছনছ হয়ে যাওয়া শিল্প-বাণিজ্যের একাংশ। বিশেষ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ব্যবসা করে যাওয়া একটি মহলের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে এমন এক সময়ে, যখন মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই ৯ শতাংশের নিচে নামছে না। এটা কমানোর চেষ্টায় সুদের হার বাড়ানোর ফলে আবার ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। এসএমইতেও বাড়ছে ব্যয়। এতে উল্টো ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।

এর মধ্যে অবশ্য সুখবর– আরও বেশি করে বাজারে ন্যস্ত হওয়ার পরও ডলারের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল। এতে আমদানি ব্যয়জনিত মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের অনেকটা সময় আন্তর্জাতিক বাজারও শান্ত ছিল; এমনকি নিম্নগামী। আমাদের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এটা বিশেষভাবে ইতিবাচক। 

নতুন অর্থবছর শুরুর আগ দিয়ে অবশ্য জ্বালানির বাজার অস্থির হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল ইরানে ইসরায়েলের হামলা ঘিরে। জ্বালানি পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকিও দিয়েছিল ইরান। এতে আমাদের এলএনজি আমদানি ঝুঁকিতে পড়তে পারত। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যে সংকটে পড়ত আমাদের শ্রমবাজার। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রও, যেটা আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্যের মূল বাজার। যা হোক, সে পরিস্থিতি কেটেছে বলে রক্ষা। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কথা তো সবারই জানা। জ্বালানি থেকে খাদ্যপণ্যের বাজারও অশান্ত হয় সেই কারণে। বিগত সরকারের আমলে রিজার্ভের অব্যাহত ক্ষয়ও ঘটে ওই পরিস্থিতিতে। এখন প্রশ্ন, নতুন অর্থবছরে কেমন থাকবে আন্তর্জাতিক বাজার? 
জ্বালানির দাম আর না বেড়ে বর্তমান স্তরে থাকলেও আমরা নানামুখী সুবিধা পাব, সন্দেহ নেই। কৃষিপণ্যের উৎপাদন আশানুরূপ রাখা গেলে আমদানিও কম করতে হবে। ভুট্টার মতো পণ্যের আমদানি কমছে দেশে উৎপাদন বাড়ছে বলে। তবে ধানের বদলে ভুট্টা চাষ বাড়লে সেটা আবার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। 

এসব দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ অবশ্য তেমন পাবে না অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন অর্থবছরের মধ্যভাগেই তাদের বিদায় নেওয়ার কথা। এডিপি বাস্তবায়নের ‘পিক সিজন’ তারা পাবেও না। এর আকার ‘যৌক্তিক’ করে ফেলে ভালোই করেছে। ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন করা গেলেও এতে পণ্যসামগ্রী সরবরাহকারীরা কম লাভবান হবে না। কর্মসংস্থানও কিছুটা হবে। তবে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে প্রধানত বেসরকারি খাতে। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে আর চলমান গ্যাস সংকটে সেটা কতখানি সম্ভব, কে জানে!
নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগ বাড়ার কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তি শুল্কের ঝুঁকিও যেভাবে হোক কাটাতে হবে। নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি যতই বাড়ুক, পুরোনো বাজার হারানো চলবে না। 

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক

আরও পড়ুন

×