ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার : ফরহাদ মজহার

জনগণ সকল প্রকার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ে চলছে

জনগণ সকল প্রকার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ে চলছে

ফরহাদ মজহার

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫ | ১৪:১০ | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫ | ১৪:২৪

কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ফরহাদ মজহার দেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা-উবিনীগ এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদনা করছেন ‘চিন্তা’। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’, ‘মোকাবিলা’, ‘এবাদতনামা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’, ‘ক্ষমতার বিকার’ ইত্যাদি। ফরহাদ মজহারের জন্ম ১৯৪৭ সালে নোয়াখালীতে। এই সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ আজ প্রকাশ হচ্ছে; বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে দ্বিতীয় অংশ। সমকালের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।

সমকাল: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল; বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে এগোচ্ছে?

ফরহাদ মজহার: প্রশ্নটা কিন্তু বিমূর্ত হয়ে গেল। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, তা বুঝতে হলে আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আমলে নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় নিতে হবে।

সমকাল: একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?

ফরহাদ মজহার: প্রথমে ৫ আগস্টের পরে ৮ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ ঘটেছে। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের যে গাঠনিক ক্ষমতা বা ‘কনস্টিট্যুয়েন্ট পাওয়ার’ জনগণ পেয়েছিল, জনগণের সেই ক্ষমতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রক্ষমতা ও কাঠামো রক্ষার শপথ নেওয়ার পর পুরোনো আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের নামে তামাশা চালানো হয়েছে। এই সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে যাদের যুক্ত করা হলো, তাদের খুব কমই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন; কেউ কেউ গণঅভ্যুত্থানের সমর্থকও ছিলেন না। গণবিচ্ছিন্ন এলিট বা অভিজাত শ্রেণির নেতৃত্বে সংস্কার চলছে। এর একটা গালভরা নামও আছে; ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। অর্থাৎ লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণিসহ দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী ও করপোরেট শক্তির মধ্যে নতুন বোঝাপড়া। পুরোনো ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোর গায়ে নতুন রংচং মেখে হাজির করা।

সমকাল: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কি তাহলে কথাই থেকে যাবে?

ফরহাদ মজহার: জনগণ সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে। এটাই বাস্তব ইতিহাস। জনগণ নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠনের জন্য অকাতরে শহীদ হয়েছে, আর পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছে– এদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। বিস্ময়কর যে খোদ জনগণকেই এই তথাকথিত ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সমকাল: জনগণ বিক্ষোভ করতে পারছে; মত প্রকাশ করতে পারছে কি? 

ফরহাদ মজহার: আপনি দেখবেন, যখন ‘মব’ একের পর এক মাজার ভাঙা শুরু করেছিল– তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। উল্টা কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা লেখার জন্য কারাগারে পাঠানো হলো। অর্থাৎ একদিকে জনগণকে অস্বীকার, তাদের গণতান্ত্রিক সামষ্টিক শক্তি বা গাঠনিক ক্ষমতাকে দমন করা হলো, আবার অন্যদিকে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়বার গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়কে নস্যাৎ করে সংস্কারের নামে পুরোনো ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষার চেষ্টা দৃঢ়ভাবে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 
গণঅভ্যুত্থান হয়ে গিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘রেজিম চেঞ্জ’। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক জেফরি স্যাকস ১৮ আগস্ট দাবি করলেন, ‘দ্য ভেরি স্ট্রং এভিডেন্স অব দ্য ইউএস রোল ইন টপলিং দ্য গভর্নমেন্ট অব ইমরান খান ইন পাকিস্তান রেইজেজ দ্য লাইকলিহুড দ্যাট সামথিং সিমিলার মে হ্যাভ অকারড ইন বাংলাদেশ’ (পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকার পতনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার খুবই শক্ত প্রমাণ রয়েছে। এ থেকে ধারণা তৈরি হয়, একই রকম কিছু বাংলাদেশে ঘটে থাকতে পারে)। কথাটা তো ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।

সমকাল: তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ পরিস্থিতি কীভাবে বিচার করব?

ফরহাদ মজহার: আরেকটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হতে শুরু করেছে। সেক্যুলার বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদের বিপরীতে বাংলাদেশকে ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত করা। প্রথমত, দীর্ঘকাল ইসলামবিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতির ফলে ইসলামের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক বোঝাপড়া আমরা করিনি। পাশ্চাত্যে গ্রিক দর্শনের আশ্রয়ে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টীয় সমাজে চিন্তা ও রাজনৈতিক পরিসরে যে রূপান্তর ঘটেছে, আমরা আমাদের সমাজে সেই ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে পারিনি। নামাজ-কালাম, এবাদত-বন্দেগি ছাড়া ইসলাম থেকে নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা গ্রহণ করবার কোনো শক্তিশালী ধারা বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। এমনই যে নানান ফেরকা, মতবাদ এবং পরস্পরকে কাফের-মুরতাদ প্রমাণ করার ছড়াছড়ির নাম ইসলাম হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির লুটপাট এবং আন্তর্জাতিক বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্যের কারণে আমরা একটি অনুন্নত ও সস্তায় শ্রম বেচাবিক্রির দেশে পরিণত হয়েছি। ফলে ইহলৌকিক জীবন মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনা পূরণ করতে পারে, সে ভরসা গরিব ও প্রান্তিক জনগণ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে মানুষ পরকালাশ্রয়ী; অর্থাৎ পরকালই সত্য, ইহলোক মিথ্যা এবং ইহলোকে কিছু পাবার আশা নেই– এই বিশ্বাস গরিব ও প্রান্তিক জনগণের মধ্যে প্রবল হয়েছে। ধর্মচর্চাও ক্রমশ এক শ্রেণির পরকাল ব্যবসায়ীর হাতে চলে গিয়েছে। ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনাও ইতিবাচকভাবে নয়, ইহলোকে অবিশ্বাসী বা পরকালবাদী তত্ত্বে পর্যবসিত হচ্ছে। সমাজ ও রাজনীতির জন্য এটা ভয়াবহ হতে পারে। বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয়ের পর নতুন ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক শর্ত বাংলাদেশে হাজির হয়েছে। 

সমকাল: এই পরিপ্রেক্ষিতে ভূরাজনীতির পরিগঠন কেমন হবে বলে মনে করছেন? 

ফরহাদ মজহার: খেয়াল করুন, আগস্টের পর কয়েক মাসজুড়ে যে ভূরাজনৈতিক অবস্থা ছিল, সেটা এখন সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। আমরা ইতোমধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করেছি, সেটা আগের চেয়ে পরিষ্কার। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে, গাজাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া এবং জায়নিস্ট ইসরায়েলের রিয়েল টাইমে গণহত্যার দৃশ্য সারা দুনিয়ার মানুষ দেখেছে। ইরান হামলার মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরও পরিণত রূপ গ্রহণ করেছে। এক মেরুর যে বিশ্ব, সেখান থেকে পৃথিবীর তিন মেরুর একটা লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধের লড়াই দেখুন। জায়নবাদের বিরুদ্ধে ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলিমসহ আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে যে লড়াই, সেটা বৈশ্বিক লড়াই হিসেবে হাজির হয়েছে। দেখুন, নিউইয়র্কে মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিসেবে জোহরান মামদানি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মুসলমান, নাকি সমাজতন্ত্রী– তা নিয়ে ভোটারদের মাথাব্যথা নেই। দুনিয়াব্যাপী যে ব্রুটাল পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা জারি রয়েছে এবং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইসরায়েলকে সামনে রেখে যে মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স দাঁড়িয়ে আছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান সেই বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ; বাইরের কিছু না। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

সমকাল: এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী করণীয়?

ফরহাদ মজহার: ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখে বাংলাদেশের জন্য সঠিক রাজনৈতিক কৌশল ও নীতি ঠিক করতে সক্ষম কোনো রাজনৈতিক দল আমরা দেখছি না। আমি মনে করি, ছাত্র-তরুণদের যত ব্যর্থতাই থাকুক– গণমানুষের সামষ্টিক অভিপ্রায়কে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের জন্য গণরাজনৈতিক ধারা তারা অবশ্যই গড়ে তুলতে পারবে। সামনে অনেক ওঠাপড়া, বাধা-বিপদ আছে। তবে ৫ আগস্ট প্রমাণ করে দিয়েছে, এটা ঘটে যাচ্ছে। ঘটবে। আমি এবং আমার বন্ধুরা সেই প্রক্রিয়ার ভেতর কিংবা বাহির– সকলভাবেই হাজির থাকব। 

সমকাল: এই বাস্তবতায় বর্তমান সরকারকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ফরহাদ মজহার: ড. ইউনূসকে আমরা কেন চেয়েছি? আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক রূপান্তরের কেন্দ্রে থেকে তিনি যেন জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন। কাজটা তো সহজ নয়। পরিস্থিতিও স্বাভাবিক নয়। তিনি তাঁর মতো চেষ্টা করছেন। ভারতকে তাৎক্ষণিক মোকাবিলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে সমঝোতা তিনি করতে পারবেন– এই আস্থা আমাদের আছে। ভারত যেন আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের রূপান্তরে হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং বাংলাদেশকে লুটপাটের ক্ষেত্র মনে না করে, সে জন্য ড. ইউনূসকে আমাদের দরকার ছিল। এর কুফলটা হচ্ছে এই, জেফরি স্যাকসরা এখন বলছেন– বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্য রেজিম চেঞ্জ হয়েছে। এই হাল আমরা সহজে বদলাতে পারছি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন করে রেজিম চেঞ্জ করতে চেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও রেজিম চেঞ্জ হয়েছে কি? এই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তিনি ব্যর্থ হলে জেফরি স্যাকসের মূল্যায়ন সঠিক বলে প্রমাণিত হবে। জেফরি স্যাকস আমাদের গণআকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছেন বটে, কিন্তু কথা পুরোটা মিথ্যা নয়। ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে ড. ইউনূসকে অনেক প্রজ্ঞাবান ও সতর্ক হতে হবে।

সমকাল: তাহলে বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যৎ কেমন হবে?

ফরহাদ মজহার: ওপরে যা বললাম, সেই সকল কারণে আমাদের ভবিষ্যৎটা খুব ভালো বলে আমি মনে করছি না। ফলে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। একদিকে ফ্যাসিস্ট শক্তি– আওয়ামী লীগ নামে যেটি হাজির ছিল, বাঙালি জাতিবাদ আকারে হাজির ছিল; আমাদের দুর্বলতার সুযোগে পরাজিত শক্তি শক্তিমান হবে। পাশাপাশি তার সঙ্গে জোট বাঁধবে জাতিবাদী ইসলাম। জাতিবাদী ইসলাম ফ্যাসিবাদের অপর নাম। ফলে জনগণের গণসার্বভৌমত্ব বা গণআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে যে একটা গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের সুযোগ ছিল, সেটি অনেক বেশি রুদ্ধ হবে। 

সমকাল: তাহলে আমাদের করণীয় কী?

ফরহাদ মজহার: আগামীর লড়াইটা কঠিন হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ভীতির কোনো কারণ নেই। আমি মনে করি, এই পোলারাইজেশনটা ভালো। এই পোলারাইজেশন তরুণদের বিশাল একটা অংশকে অনুপ্রাণিত করবে যে জুলাইয়ের বিপ্লবী স্পিরিটকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে কী করা দরকার। এখন যাদের আমরা ভুল করতে দেখছি, এদিক-সেদিক করছে, এরা ঠিকই আবার রাস্তায় থাকবে। আমি এদের ওপর আশা ছাড়তে রাজি না। কারণ এরাই গণঅভ্যুত্থানটা করেছে। এই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আমরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে যেমন এগিয়ে যেতে পারি, একই সঙ্গে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও।

সমকাল: আপনার এত আস্থার কারণ কী? 

ফরহাদ মজহার: যদি গণসার্বভৌমত্ব কায়েমই গণতন্ত্র হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে হলে জনগণের ওপর আস্থা রাখতেই হবে। আর লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির পক্ষে থাকলে আপনি নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে থাকবেন। জনগণের ওপর আস্থা তো থাকতেই হবে। জনগণের যে অংশটা রূপান্তর চায়, তারা না খেয়ে হলেও তাদের নেতাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

সমকাল: গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখতে হলে এই মুহূর্তে কী করণীয়?

ফরহাদ মজহার: আমাদের মনে রাখতে হবে, ৮ তারিখে একটা সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব হয়েছে। এই প্রতিবিপ্লবের পরে যদি আমরা এগোতে চাই, তাহলে সাময়িক হলেও জনগণের গাঠনিক শক্তিকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। এটা তো সহজ কাজ নয়। একবার যখন গাঠনিক মুহূর্ত বেহাত হয়, চলে যায়, তখন ফিরিয়ে আনা কঠিন কাজ। সমাজে যে শ্রেণি লুটেরা-মাফিয়াদের পক্ষে ছিল, তারাই কিন্তু কাজটা করেছে। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ও তার পক্ষে যেসব মতাদর্শ সমাজে কার্যকর এবং যে এলিট ও ধনীরা মিলে লুটেরা-মাফিয়াদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুন বন্দোবস্ত দ্বারা চালু রাখতে চায়, তাদের ধরে ধরে এনে আপনি কমিশন বানাবেন। আর নতুন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বানাবেন না; জনগণকে বানাতে দেবেন না। তথাকথিত সংস্কার করবেন– এই সংস্কার তো এমনিতেই ব্যর্থ হবে। যে সাংবিধানিক কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে, আজকের পত্রিকায় দেখলাম, সেই ক্ষেত্রে ঐকমত্য সম্ভব হবে না। এটা তো আমরা প্রথম থেকেই বলছিলাম। লড়াইটা জনগণ বনাম ফ্যাসিস্ট শক্তির। 

সমকাল: এই সংকট থেকে বেরোনোর কি কোনো পথ নেই? 

ফরহাদ মজহার: এখান থেকে বেরোবার একমাত্র পথ হচ্ছে বুঝতে পারা যে, লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আত্মঘাতী পথ। এখান থেকে বেরুতে হবে। এখান থেকে বেরুতে হলে প্রথমত আমাদের গণসার্বভৌমত্বের ধারণাটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার তৈরি হয়ে আছে। সেটা হলো, গণসার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন। বিপরীতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তথাকথিত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া গণঅভিপ্রায় নস্যাৎ করা, প্রতিবিপ্লবী রাজনীতিকে বৈধকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করা ইত্যাদি।

সমকাল: তাহলে সরকার যে নির্বাচনের কথা বলছে, তার কী হবে?

ফরহাদ মজহার: নির্বাচন যে বাংলাদেশকে একটা ভালো জায়গায় নেবে– এটা সাধারণ মানুষ তো বিশ্বাস করে না। তাহলে জবরদস্তি করে এটা চাপিয়ে দেওয়া ভুল। আবার সাধারণ মানুষ এই আস্থাও হারিয়েছে যে, ড. ইউনূস তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন। এটা হলো রাজনৈতিক বাস্তবতা। জনগণ যা চাইছে তা বোঝার মতো মানসিকতা অন্তর্বর্তী সরকারের চাই। নির্বাচন করার ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি নেই? নির্বাচন করতে হলে আপনি কাকে দিয়ে নির্বাচন করবেন? যাদের দিয়ে নির্বাচন করাবেন, তারা নিজেদের লোকদের নির্বাচন করিয়ে আনবে। এই নির্বাচনে জনগণ কী পাবে? ঠিক ২০০৮ সালে বিএনপি যে ভুলটা করেছে, এটা হবে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি। 

সমকাল: তাহলে কি অন্তর্বর্তী সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকবে?

ফরহাদ মজহার: না। আমি সে কথা বলিনি। সরকার তো গঠনের প্রক্রিয়াই শুরু করেনি। গঠন প্রক্রিয়া মানে একটা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া। সেদিকে সরকারকে যেতে হবে।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ফরহাদ মজহার: সমকালকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

×