অন্যদৃষ্টি
উচ্চশিক্ষার সংকট ও সংস্কার

মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫ | ০৪:২৮
স্নাতক শেষের পর আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইউরোপের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেটা সায়েন্সে মাস্টার্স করতে যায়। বিষয় হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে ডেটা সায়েন্স তখনও এতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তার ওপর পরিবার ও পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বিদেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে বন্ধুদের মাঝে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা ও সংশয় ছিল।
কিন্তু আমার ওই বন্ধু বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে আসার পর বোঝা গেল, এ সিদ্ধান্ত তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এসেই সে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো পদে যোগদান করে। উদ্ভাবনী বিষয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় এক সংস্কৃতিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অভিজ্ঞতার ফলে তার ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস থেকে শুরু করে বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজা ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতার বিকাশ ঘটে, যা তার ক্যারিয়ার দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রসঙ্গে ওপরের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে উদ্ভাবন, গবেষণা, প্রযুক্তির ব্যবহার ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলে, বাংলাদেশের প্রচলিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সেভাবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করে তুলতে পারছে না। যে কারণে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে পড়ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা।
উচ্চশিক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়।
এই পিছিয়ে পড়ার কারণও বহুমাত্রিক। প্রথমত, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশে বরাবরই অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় বাজেটের অনুপাত যেখানে কমে এসেছে, সেখানে অন্যান্য দেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করে এগিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, যোগ্য শিক্ষকের অভাব। তৃতীয়ত, ব্যবসা, শিল্প ও শিক্ষা খাতের মধ্যে ব্যবধান। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও ব্যবসা, শিল্প খাতের মধ্যে ব্যবধান হ্রাসে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইনোভেশন হাব, রিসার্চ ল্যাব ও স্টার্টআপ ইনকিউবেটর তৈরি করছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে এখনও বিস্তৃত পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। চতুর্থত, আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এখনও বিশ্লেষণধর্মী বা অনুশীলনমূলক নয়।
আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এখন সময়ের দাবি। যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশেষায়িত ও ভবিষ্যৎ চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। ক্যাম্পাসগুলোকে গবেষণা কেন্দ্রে রূপান্তর করতে হবে। মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল ও স্বল্পমেয়াদি কোর্স উচ্চশিক্ষার কারিকুলামের অংশ করতে হবে। ভার্চুয়াল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালুর পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ধারণার সঙ্গে পরিচিত এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কার্যকরী উপায়ে শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক বিশেষায়িত শিক্ষা প্রদান, তাদের অগ্রগতি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী সমাধান দেওয়া সম্ভব হবে, যা ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষা, ক্যারিয়ার এবং অর্থনৈতিক চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। তাই শিক্ষার্থীদের সঠিক বিকাশে কাউন্সেলিং, পিয়ার সাপোর্ট প্রোগ্রাম এবং ওয়েলনেস ইনিশিয়েটিভ চালু করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নলেজ ট্রান্সফারের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়; পরিবর্তন বা উদ্ভাবনের ওপর নয়। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়েও আমরা অনেক পিছিয়ে। যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই এ অবস্থার পরিবর্তন চাই; উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সময়।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন: ডিন অব একাডেমিক অ্যাফেয়ার্স, ইউনিভার্সাল কলেজ বাংলাদেশ (ইউসিবিডি)
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি