রাষ্ট্রচিন্তা
সাংবিধানিক সংস্কার এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

ফিরোজ আহমেদ
ফিরোজ আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০১:২৩ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০১:২৩
সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার ফলাফল নিয়ে আশাব্যঞ্জক খবর পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য মৌলিক সংস্কারগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে এবং ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে খুব বেশি মতপার্থক্য প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো একটি মেনে নিলেও আরেকটি বাদ দেওয়ার শর্ত দিচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার নিয়ে মতপার্থক্য থেকেই যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে– একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী থাকার মেয়াদকাল, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগ প্রক্রিয়া, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিমালার সংশোধন। আশার কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিরোধী দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ সংরক্ষণ এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই একমত।
ঐকমত্য কমিশন প্রথমে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল- এনসিসি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। বিএনপির ঘোর আপত্তি থাকায় নতুন প্রস্তাব দেয়। এর বদলে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠিত হবে। এতেও সায় দেয়নি বিএনপি (সমকাল, ২৬ জুন ২০২৫)।
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় কিছুটা ভারসাম্য রাখার প্রয়োজন থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা খুব বেশি খর্ব না করার মতকে উপেক্ষা করা যায় না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এক ব্যক্তি বা দলের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা যাতে সম্ভব না হয়, তার জন্য অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং সদস্যদের কোনো কমিটি বা পরিষদের মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব যৌক্তিক। তবে এটাকে বেশি ক্ষমতাশালী করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতাকে যেভাবে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করা সম্ভব, সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্বাহী ক্ষমতা বেশি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। তাতে নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়তে পারে।
তবে নির্বাহী বিভাগকে সংসদে জবাবদিহি করার প্রধান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলকে সাংবিধানিক পরিষদের এখতিয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ বোধগম্য নয়। তাহলে এই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদটি কি আগের মতোই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন? উল্লেখ্য, অডিটর জেনারেলের দপ্তর নির্বাহী বিভাগের প্রতিষ্ঠান নয়; এটি সংসদীয় প্রতিষ্ঠান। এই ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের কাছে রাখার যৌক্তিকতা নেই। বরং তা প্রস্তাবিত সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটিতে অর্পণই যুক্তিসংগত।
আমাদের দেশেই কি প্রথম সাংবিধানিক পরিষদ বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠনের ধারণা এসেছে? আমাদের দুই প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও নেপালে সাংবিধানিক পরিষদ অনেক আগে থেকেই আছে। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পুলিশ কমিশন, ঘুষ কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। সংবিধানে বর্ণিত পদগুলোতে নিয়োগে এই পরিষদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নেপালে এই পরিষদের এখতিয়ারের মধ্যে অডিটর জেনারেলের দপ্তরও রয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিল– দুই মেয়াদের বেশি কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। সেটা অন্যান্য রাজনৈতিক দল মেনে নিলেও বিএনপি সম্পূর্ণ একমত হতে পারছে না। ঐকমত্য কমিশন দুই মেয়াদের জায়গায় ১০ বছর নির্ধারণের প্রস্তাব দিলে বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, তাহলে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক কমিশন কমিটি গঠনের প্রস্তাব বাদ দিতে হবে।
গণতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টি এবং পরিবার ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ফিরে আসা বন্ধ করতে একজন ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে না থাকা এবং সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে পরিষদ বা কমিটি গঠন অপরিহার্য শর্ত। একটি অপরটির পরিপূরক নয়। অথচ একটি বাস্তবায়ন করা হলে আরেকটি বাদ দিতে হবে– বিএনপির এমন অবস্থান হতাশাব্যঞ্জক।
সংসদের উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির আপত্তি রয়েছে। অথচ শুধু উচ্চকক্ষ নয়; নিম্নকক্ষ বা প্রধান সংসদের নির্বাচনও সংখ্যানুপাতিক বা মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থায় হতে পারে। বর্তমানে যে সংসদীয় আসনভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার বড় অসুবিধা হলো দলীয় প্রার্থী বা নির্বাচিত এমপিকে সারাবছর বিশাল কর্মী বা ক্যাডার বাহিনী ভরণপোষণ করতে হয়। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এদের পেছনে একজন প্রার্থীকে ব্যয় করতে হয় ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকা। ফলে একদিকে যোগ্য কিন্তু বিত্তশালী নন এমন প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া কঠিন; অন্যদিকে প্রার্থীদের ক্যাডার বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনও অসম্ভব হয়ে পড়ে। শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাই কলুষিত করে না; চাঁদাবাজির মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও অপরিসীম ক্ষতি হয়। যেহেতু সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা আমাদের দেশে নতুন; এবার সম্ভব না হলেও অর্থ ও পেশিশক্তিবিহীন গণতন্ত্রের জন্য ভবিষ্যতে সংখ্যানুপাতিক অথবা মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থার দিকেই যেতে হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বিশ্বের ১৩০টি দেশে পুরোপুরি সংখ্যানুপাতিক বা মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ছাড়াও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের নেপাল, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় এমন ব্যবস্থা রয়েছে। নেপালে ২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে ১৬৫ জন (৬০ ভাগ) সরাসরি আসনভিত্তিক এবং ১১০ জন (৪০ ভাগ) সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত হন। শ্রীলঙ্কায় পুরোটাই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন; তবে তারা এটা জেলাভিত্তিক ও দেশভিত্তিক ভাগ করেছে।
এটা আশা জাগানিয়া; সংসদের অন্তত চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটি– পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, এস্টিমেট কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই একমত। বিশেষত ‘পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি’ বিরোধী দলের নেতৃত্বে থাকার সিদ্ধান্ত সরকারি অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক অগ্রগতি।
সংসদে বর্তমানের ৫০টি নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাবেও সব দল একমত। এটা ভালো খবর, কিন্তু সংসদে যে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নেই– সে বিষয়টির উপেক্ষা কেন? এ ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব দেখছি না। অনেক দেশে, এমনকি পাকিস্তানেও ফেডারেল ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টের ৫ ভাগ আসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত। আমাদের সংসদেও ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
মনে রাখা জরুরি, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র না থাকায় নমিনেশন বাণিজ্য ও পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসেছে। দলের সব পর্যায়ে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে কার্যনির্বাহী নির্বাচনের ব্যবস্থা না করা গেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনতার সংগ্রাম পূর্ণতা লাভ করবে না। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক সংস্কার, নাকি নির্বাচনী আচরণবিধি সংশোধন প্রয়োজন– ঐকমত্য কমিশন ভেবে দেখতে পারে।
বাংলাদেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ক্রান্তিকাল পার করছে। নাগরিকরা উন্মুখ হয়ে ভাবছে, অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর জাতি কি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে পারবে? রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তী সরকার, ঐকমত্য কমিশন যেন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরামত ও সংস্কারের শেষ সুযোগটি মিস না করে।
ফিরোজ আহমেদ: সদস্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; সাবেক কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক
[email protected]
- বিষয় :
- রাষ্ট্রদূত