ইরান
নোয়াম চমস্কির দৃষ্টিতে ইসরায়েলি হামলা

সাঈফ ইবনে রফিক
সাঈফ ইবনে রফিক
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০১:২১ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫ | ০১:২২
নোয়াম চমস্কিকে শুধু ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে চেনা যথেষ্ট নয়। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিশ্বমানবতার বিবেক হয়ে উঠেছেন বহু আগেই। গত শতকের ষাটের দশক থেকে সক্রিয় ও স্পষ্টভাষী এই রাজনৈতিক সমালোচক বরাবরই প্রশ্ন তুলেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ ও সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাত নিয়ে। চমস্কি মনে করেন, ‘ফর দ্য পাওয়ারফুল, ক্রাইমস আর দোজ দ্যাট আদারস কমিট’। ন্যায়ের সংজ্ঞা যদি পক্ষবিশেষ নির্ধারণ করে, তাহলে তা আর ন্যায় থাকে না, বরং হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতির বাহন।
চমস্কির মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক প্রকার বিকৃত নৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য এক সেট নীতি, আর দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য আরেক। এই দ্বিচারিতা প্রবলভাবে প্রতিফলিত ইরান-ইসরায়েল সংকটে। একদিকে ইসরায়েল নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি হিসেবে গোপনে রাখে এবং পশ্চিমা বিশ্ব তার অস্ত্রভান্ডার নিয়ে নীরব। অপরদিকে ইরান শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করলেও তাকে ‘বিশ্বশান্তির হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। চমস্কি বলেন, আমরা যখন ‘সন্ত্রাস’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করি, তখন সতর্ক হওয়া দরকার যে কারা এটা সংজ্ঞায়িত করছে।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুতা হঠাৎ তৈরি হয়নি। চমস্কি স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যৌথ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটিয়ে পশ্চিমা মদদপুষ্ট শাহকে পুনরায় ক্ষমতায় বসিয়েছিল। এই হস্তক্ষেপ ইরানিদের মনে গভীর রাজনৈতিক ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব কেবল শাসক পরিবর্তন নয়; বরং ছিল ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতার নামান্তর। চমস্কির মতে, বিপ্লব-পরবর্তী ইরান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে গিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের শত্রুতে পরিণত হয়।
এই শত্রুতার সবচেয়ে বড় কাঁটা হয়ে ওঠে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ২০১৫ সালের ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ চুক্তি চমস্কির দৃষ্টিতে ছিল কূটনৈতিক সমঝোতার ইতিবাচক নজির। ইরান এই চুক্তির আওতায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করে, পরিদর্শকদের ঢুকতে দেয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ মেনে নেয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন একতরফা চুক্তিটি বাতিল এবং ইরানকে নতুন নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই ঘটনাকে চমস্কি বলেন ‘কৃত্রিম সংকট তৈরির ধ্রুপদি উদাহরণ’। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রই প্রথমে চুক্তি ভঙ্গ করে সৃষ্ট সংকটের দায় চাপায় ইরানের ওপর। আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেই বয়ানকেই নিরীক্ষাহীনভাবে গ্রহণ করে।
চমস্কি আরও দেখান, কেবল নিষেধাজ্ঞা আরোপই নয়; ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার ইরানে সাইবার আক্রমণ চালিয়েছে; ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। এমনকি সামরিক হামলার হুমকিও দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। অথচ পশ্চিমা প্রচারে ঘটনাগুলো আত্মরক্ষার পদক্ষেপ বলে বৈধতা পায়। চমস্কির ভাষায়, মার্কিন নীতির মৌল ভিত্তিই হলো– নিজেরা করলে বৈধ, অন্য কেউ করলে অপরাধ।
ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার আন্তর্জাতিকভাবে ওপেন সিক্রেট হলেও যুক্তরাষ্ট্র কখনও সেটি স্বীকার করে না। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোনো রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি-এনপিটি স্বাক্ষর না করলে তাকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বেআইনি। ইসরায়েল এনপিটি স্বাক্ষর করেনি। তাই পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা বন্ধ করতে হয়। আইনি ফাঁক এড়াতে চমস্কির ভাষায়– ‘দ্য পলিসি ইজ: ডোন্ট আস্ক, ডোন্ট টেল’।
চমস্কির মতে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির জন্য অন্যতম কার্যকর ও ন্যায্য উপায় হতে পারে গোটা অঞ্চলকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত ঘোষণা। ইরান একাধিকবার এই প্রস্তাব দিয়েছে; আরব রাষ্ট্রগুলোরও দীর্ঘদিনের দাবি; জি৭৭ গোষ্ঠীর দেশগুলোও এ প্রস্তাবকে সমর্থন করে। কিন্তু এ উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরোধিতায়। চমস্কির প্রশ্ন, যদি বিশ্বশান্তিই উদ্দেশ্য হয়, তবে কেন দুই রাষ্ট্রই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে বাধা দিচ্ছে?
‘ন্যায্য যুদ্ধতত্ত্ব’ সম্পর্কে চমস্কির মত– এটি এক ধরনের মতামতভিত্তিক কাঠামো, যা বাস্তবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনি মনে করেন, আফগানিস্তান বা ইরাক যুদ্ধকে পশ্চিমা বয়ানে ‘ন্যায্য’ বলা হলেও আসলে আগ্রাসনেরই পরিপাটি কেস স্টাডি।
ইসরায়েল যদি ইরানে হামলা চালায়; পশ্চিমা বয়ানে সেটা ‘প্রি-এম্পটিভ’ বা কল্পিত বিপদের আশঙ্কা থেকে আঘাত। অথচ জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আত্মরক্ষা কেবল তখনই বৈধ, যখন আগ্রাসন বাস্তবে সংঘটিত হয়। চমস্কির মতে, প্রি-এম্পটিভ আঘাত প্রতিরক্ষা নয়; আগ্রাসন।
ইরান বর্তমানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক অবরোধ, সাইবার আক্রমণ ও সামরিক হুমকির মুখে। চমস্কি প্রশ্ন করেন– ‘তাহলে কি ইরানেরও অধিকার আছে পাল্টা প্রতিরোধমূলক হামলা চালানোর?’ তাৎক্ষণিক সেটি অগ্রহণযোগ্য আখ্যা পায়। এই অসামঞ্জস্যই চমস্কির মতে আধুনিক নীতিবোধের বিপর্যয়। তাঁর মতে, যদি ইসরায়েলের উদ্বেগ বৈধ হয়, তবে ইরানের উদ্বেগও সমানভাবে ন্যায্য।
চূড়ান্তভাবে চমস্কি যুদ্ধ নয়; শান্তি ও সংলাপের পথকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষপাতী। তিনি বলেন, হয় আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে হবে, না হয় আমরাই বিলুপ্তির মুখোমুখি হবো। তাঁর অবস্থান, সব রাষ্ট্রকেই আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে– বন্ধু হোক বা শত্রু। এই অবস্থান নিছক নীতিকথা নয়; বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের প্রতি জরুরি আবেদন।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত রাজনৈতিক হলেও গভীর নৈতিক সংকটও বটে। এই সংকটে কেবল পারমাণবিক অস্ত্র নয়, সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্ন জড়িত। চমস্কি বিশ্বাস করেন, সত্যিকারের শান্তি তখনই সম্ভব, যখন আমরা দ্বিচারিতা পরিহার করে প্রত্যেক মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও জীবনের গুরুত্ব সমানভাবে বিবেচনা করব; হোক সে ইরানি কিংবা ইসরায়েলি।
সাঈফ ইবনে রফিক: কবি ও সাংবাদিক
- বিষয় :
- ইরান