ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

চিরনিদ্রায় শায়িত সাজেদা চৌধুরী

চিরনিদ্রায় শায়িত সাজেদা চৌধুরী

বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। ফাইল ছবি

সমকাল প্রতিবেদক ও নগরকান্দা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০৮:০১ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০৯:১১

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সোমবার ঢাকা ও ফরিদপুরের নগরকান্দায় দুই দফা জানাজা এবং সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে।

শনিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যান সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সোমবার সকাল ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে তা বাতিল করা হয়। পরে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে তাঁর মরদেহ সকাল পৌনে ১১টায় নিজ নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুরের নগরকান্দায় পৌঁছে। সেখানকার সরকারি এমএন একাডেমির মাঠে সকাল সোয়া ১১টায় প্রথম জানাজায় সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। 

জানাজার আগে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকস দল বর্ষীয়ান এই নেতার মরদেহের প্রতি গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ও সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী। 

এ সময় বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদনকালে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, ফরিদপুর জেলা সভাপতি শামীম হক. সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ ইশতিয়াক আরিফ, ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. শাহ্‌জাহান, নগরকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম ইমাম রাজী টুলু, উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী খান বুলু, আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু সেনা পরিষদের সভাপতি মেজর (অব.) আতমা হালিম প্রমুখ।

পরে জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুর আড়াইটায় তাঁর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী দল ও সংগঠনসহ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাজনৈতিক সহকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হন সংকটে সংগ্রামে দেশ ও দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটি।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম সালাহউদ্দিন ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবির আহমেদ মরদেহের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। এ সময় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সহকর্মী সাজেদা চৌধুরী দলের সংকটে সাহসী নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছেন তিনি। তাঁর শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।

এরপর একে একে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও জোটের সমন্বয়ক-মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে ১৪ দল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, দলীয় সভাপতি রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি, দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি-জেপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আক্তারুজ্জামান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ রিংকু, দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ খান, সংগঠনের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, অ্যাডভোকেট মোলতা মো. আবু কাওছার ও একেএম আফজাল বাবুর নেতৃত্বে ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই   অ্যাসোসিয়েশন এবং সংগঠনের সাবেক সভাপতি অমরেশ রায়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আছাদুজ্জামান ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান আহমেদের নেতৃত্বে ফরিদপুর জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন ঢাকার নেতারা শ্রদ্ধা জানান। 

এছাড়া জাসদ, বাসদ, গণআজাদী লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, মহিলা শ্রমিক লীগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মহিলা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট এবং মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, সংকটকালেও তিনি দলের পাশ থেকে সরে যাননি। আপস করে রাজনীতি করেননি। নতুন প্রজন্মকে তাঁর নেতৃত্ব অনুসরণ করা উচিত।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলেও সাজেদা চৌধুরীর নাম থাকবে। তাঁর এই বিদায়ে দেশ একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছে।

নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তাঁর পুরো জীবনটাই বর্ণাঢ্য একটা ইতিহাস। এই ইতিহাস আমাদের ধারণ করতে হবে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, তিনি এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারের নেত্রী ছিলেন। যিনি আজীবন আদর্শ অনুসরণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় নারী সংগঠক হলেন সাজেদা চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধে নারী নেত্রীদের মধ্যেও তিনি ছিলেন এক নম্বরে। তাঁর অবদান আমাদের মনে রাখতে হবে।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, সাজেদা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এ পর্যন্ত পরিচিত একটি মানুষ ও একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় ছিলেন তিনি।

পরিবারের পক্ষে সাজেদা চৌধুরীর মেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শামা রহমান বলেন, মায়ের প্রতি সর্বস্তরের মানুষ যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, সেটা নিশ্চয়ই মা প্রতি পদে পদে উপলব্ধি করতে পারছেন। বৃষ্টির মধ্যেও এত মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন, তার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিকেল পাঁচটায় সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে আসা হয় তাঁর চিরচেনা আঙিনা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। সেখানে জাতীয় ও দলীয় পতাকায় মোড়ানো মরদেহের কফিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলীয় নেতারা শেষ শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এ সময় সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে তাঁর মা সারাজীবন মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে গেছেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ পরিবারের একজন সদস্য। তাঁর মায়ের জন্য দোয়া কামনা করেন তিনি।

পরে বাদ আছর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে সন্ধ্যা ছয়টা ২০ মিনিটে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। দাফনের সময় পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে চট্টগ্রামেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিভিন্ন মহল থেকে। ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া সাজেদা চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায়।

আরও শোক: সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক ও শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজম নাছির উদ্দীন, দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ খান, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ রিংকু, আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু সেনা পরিষদের সভাপতি মেজর (অব.) আতমা হালিম, নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী খান বুলু।

আরও পড়ুন

×