আ'লীগে গুরুত্ব হারাচ্ছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা

অমরেশ রায়
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ০৬:০০
একটা সময় ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ঠাঁই পেতেন। জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতেন। দলের মনোনয়নে এমপি-মন্ত্রী হতেন। কিন্তু গত ছয়-সাতটি জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হচ্ছে, সেখানে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের প্রাধান্য আর আগের মতো নেই। ছাত্রলীগের সাবেক শীর্ষ নেতা বিশেষ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা নেতাদের কেউ-ই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসতে পারছেন না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানান, গত দেড় বা দুই যুগে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে যাঁরা এসেছেন- তাঁদের অধিকাংশ ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ও আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারেননি। বেশির ভাগই নানা অপকর্ম ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সংগঠনের সম্মান ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছেন। ফলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের বিরাগভাজন হয়েছেন। এ কারণে শেখ হাসিনা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচনকালে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের আর আস্থায় নিতে পারেন না। এ জন্য মূল দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এখন আর ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের তেমন দেখা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত এবারের কেন্দ্রীয় কমিটি বিশ্নেষণ করলে এর সত্যতা মিলবে। গত দুই যুগে সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের কারও নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই হয়নি। আগে থেকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন, শুধু তাঁরাই ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এবং উপদেষ্টা পরিষদে এসেছেন। তাঁদের কারও কারও কর্মদক্ষতার গুণে পদোন্নতিও হয়েছে। অবশ্য তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতার ঠাঁই মিলেছে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিতে। জাতীয় কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া নেতাদের কারোই ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ-পদবি ছিল না।
এর আগে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে বড় ভূমিকা রেখেছেন। ফলে তাঁদের মূল দলে নেতৃত্বে আসার সুযোগ মিলেছে। পরে তাঁরাই জাতীয় পর্যায়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক এবং সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদের কথা সর্বাগ্রে চলে আসে। আব্দুর রাজ্জাক পঁচাত্তর-পরবর্তী দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। একাধিক মেয়াদে মন্ত্রীও ছিলেন।
একইভাবে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক হিসেবে খ্যাত ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদ একাধিক মেয়াদে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন দলের 'থিংক ট্যাংক' হিসেবে পরিচিত উপদেষ্টা পরিষদে টানা চতুর্থবারের মতো সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ। একইভাবে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বেশ কয়েক দফায় সরকারের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
একইভাবে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান- তিনজনই আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। একাধিক মেয়াদে সংসদ সদস্য হওয়া ছাড়াও এই তিন নেতার মধ্যে অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এক মেয়াদে সরকারের প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং দলের হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন।
এ ছাড়া ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, প্রয়াত আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, প্রয়াত আবদুল মান্নান প্রমুখও বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম এর আগে কয়েক দফায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এখন সরকারের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কাছাকাছি সময়ের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করা মাজহারুল হক বাকী, বাহালুল মজনুন চুন্নু, মোহাম্মদ শাহে আলম, মঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী, ইকবালুর রহিম এমপি, ইসহাক আলী খান পান্না প্রমুখ এখনও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো পদ পাননি।
অবশ্য বিভিন্ন সময় দলত্যাগ করে বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের অনেকেও অতীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদ অথবা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বিভিন্ন মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এসব নেতার মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন- প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমান, প্রয়াত শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে চার খলিফা খ্যাত সাবেক ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব, প্রয়াত শাজাহান সিরাজ, স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস বলে খ্যাত সিরাজুল আলম খান, প্রয়াত ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, আবদুর রউফ, শেখ শহীদুল ইসলাম, ফজলুর রহমান, সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ প্রমুখ।
এদিকে, ছাত্রলীগের শীর্ষপদে না থাকলেও বিভিন্ন মেয়াদে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা নেতাদের মধ্যে অনেকে বর্তমান আওয়ামী লীগে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পুনর্নির্বাচিত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, এসএম কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন, আনিসুর রহমান, সাহাবুদ্দিন ফরাজী, ইকবাল হোসেন অপু এমপি, গোলাম রাব্বানী খান চিনু, মারুফা আক্তার পপিসহ অনেকেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে উঠে এসেছেন মূল দলে।
নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউই এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পদ-পদবি পাননি। কয়েকজন অবশ্য অধুনাবিলুপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সম্পাদক পদে ছিলেন। অনেকেই আবার এখনও কম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হিসেবে রাজনীতির মাঠে রয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য দলের সহযোগী অন্য সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন।
এই ধারায় গত প্রায় দুই যুগে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই মেলেনি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অথবা সাবেক সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকা বাহাদুর বেপারী, অজয় কর খোকন, লিয়াকত শিকদার, মাহমুদ হাসান রিপন এমপি, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ, নাজমুল আলম সিদ্দিকী, সাইফুল ইসলাম সোহাগ, বিএম জাকির হোসেন, রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, গোলাম রাব্বানী, সদ্য বিদায়ী আল-নাহিয়ান খান জয় এবং সদ্য বিদায়ী লেখক ভট্টাচার্য্য।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই না পাওয়া এই নেতাদের মধ্যে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানী তাঁদের মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের টেন্ডারে কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে যুক্ত থাকায় ছাত্রলীগের পদ থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। বাকিদেরও বেশির ভাগের বিরুদ্ধে নানা অপরাধ ও অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন অথবা নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এসব কারণেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসার সৌভাগ্য হয়নি।
আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেছেন, আসলে সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা ছাত্রলীগের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন- তাঁদের অনেকেই এমন কিছু কর্মকাণ্ড করে গেছেন, যেগুলো আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতির আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালনকালে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। যেটা পরবর্তী সময়ে তাঁদের মূল দলে আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।