ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার: তানজিম আহমদ সোহেল তাজ

হাসিনার ইন্ধনে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি

হাসিনার ইন্ধনে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি

তানজিম আহমদ সোহেল তাজ

শাহেদ চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৪:৫৫ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:৩৯

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইন্ধন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন একসময়ে তাঁর সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্প্রীতি নষ্টের ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি (শেখ হাসিনা) ভারতের প্রেসক্রিপশনেই সবকিছু করছেন। ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করেছেন। 

সোহেল তাজ আরও বলেন, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করব। আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে মাথা নত করে থাকব না। শেখ হাসিনাকে ভারত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে নিযুক্ত করে রেখেছিল। তাই উৎখাতের পর তিনি সেখানেই চলে গেছেন। আর তাঁকে উৎখাত মানেই ভারতকে বিতাড়ন করা। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও এনেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ ও ফালতু মামলায় জড়িয়ে রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে তুলাধুনা করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বর্ষীয়ান এই রাজনীতিককে ন্যক্কারজনকভাবে বাসভবন থেকে বের করে দিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিষিদ্ধ করেছেন। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে অপমান ও অপদস্থ করেছেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশ যেতে দেননি। সমকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও দলের সহসম্পাদক সোহেল তাজ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন উপসম্পাদক শাহেদ চৌধুরী।

সমকাল : শেখ হাসিনার দেশত্যাগকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?

সোহেল তাজ: শেখ হাসিনার দেশত্যাগ দেশ ও আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয়কর। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। 

সমকাল : বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর পালানোর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা পতনের পর পালিয়ে গেলেন কেন?

সোহেল তাজ : জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ অনেকটা মাফিয়া কায়দায় রাষ্ট্র ও দল পরিচালনা করেছে। ফলে জনগণ ব্যাপকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। প্রস্তুত হয় বিস্ফোরণের প্রক্রিয়া। এর চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে জুলাই-আগস্টে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে। ইকো চেম্বার পার্টি আওয়ামী লীগ জনগণের এই মনোভাব বুঝতে পারেনি। ফলে দেশত্যাগ ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। 

সমকাল : সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের বেহাল দশার কারণ কী?

সোহেল তাজ : রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে দলের সশস্ত্র কর্মী দিয়ে ২ হাজারেরও বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ৬শর বেশি মানুষ অন্ধ। হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু। দেশের ইতিহাসে এমন নির্মম, নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম গণহত্যা কখনও হয়নি। এরশাদকে স্বৈরাচার বলা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা স্বৈরশাসকের মাত্রাও পেরিয়ে গেছেন। তিনি নির্বিচারে শিশু হত্যা করেছেন। যুদ্ধেও এত শিশু নিহত হয় না। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এ রকম অপচেষ্টা আগে কেউ করেনি। 

সমকাল : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান কেন হলো? 

সোহেল তাজ : বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক। তাঁর মেয়ে হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে জাতির অনেক কিছু প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তাঁর ১৫ বছরের দুঃশাসন মানুষকে হতাশ করেছে। এর পাশাপাশি তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনও জনবিস্ফোরণে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা না করে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা বিডিআর হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে ইসলামের ওপর হামলা, ভোটারবিহীন নির্বাচন, দলের নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, চার বছরের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ পাচার, নির্দেশপুষ্ট বিচার বিভাগ, দুঃশাসন, দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, রাতের ভোট, ডামি নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন-খুন-গুমের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসকে রূপ নেয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আর থাকেনি। গোটা দল শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এসবের পরিণতি ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থান। 

সমকাল : আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের জন্য কাকে দুষছেন? 

সোহেল তাজ: দুর্ভাগ্য, একটি রাজনৈতিক দল তাঁর নেতৃত্বের কারণে জঘন্যতম গণহত্যা করেছে। জনবিরোধী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। আসলে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের জন্য শেখ হাসিনা এককভাবে দায়ী। তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। তাঁর পরিবারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। 

সমকাল : সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে আওয়ামী লীগের করণীয় কী?

সোহেল তাজ: নীতি ও আদর্শ বিচ্যুত আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটেছে। এই বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে। গুম, খুন ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতেই হবে। এর পাশাপাশি আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা ও অনুতপ্ত হয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে ফিরে আসতে পারবে। তবে শেখ হাসিনাসহ তাঁর পরিবার ও অপকর্মে সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের কারণে আওয়ামী লীগের আজকের যে দুরবস্থা, তাদের রেখে আওয়ামী লীগ কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। 

সমকাল : আওয়ামী লীগের ঝটিকা কর্মসূচিকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?

সোহেল তাজ : এটা আওয়ামী লীগকে ধ্বংস ও নিরীহ কর্মীদের বিপদে ফেলার আরেকটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। কেননা, এর মধ্য দিয়ে যারা এই দলটাকে ডুবিয়েছে, তারাই আবার ক্ষমতার জন্য ফিরে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু এটা অসম্ভব। 

সমকাল : অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী?

সোহেল তাজ: মহান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও সব নাগরিকের সমান অধিকার চাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেসব ইস্যুর কথা বলেছে, তার সবটাই চাই। যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বৈষম্য থাকবে না। অন্যায়-অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে। এসব করতে হলে পর্যাপ্ত সংস্কারের প্রয়োজন। নিশ্চয়ই সরকার তা করবে। 

সমকাল : অন্তর্বর্তী সরকার কি মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে?

সোহেল তাজ : না। অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশার পুরোটা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হচ্ছে। ঘুরেফিরে ১৫ বছরের দুঃশাসন ফিরে আসছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকারকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অবশ্য আগামী দুই মাসের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। 

সমকাল : আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে। 

সোহেল তাজ: কিছু অর্থবহ সংস্কারের পর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ কিংবা বাদ দিয়ে নির্বাচন করাটা ঠিক হবে না। 

সমকাল : গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি চান কিনা?

সোহেল তাজ : সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে গণহত্যায় জড়িতদের বিচার চাই। 

সমকাল: আওয়ামী লীগ আবারও দেশকে শোষণ করার চক্রান্ত করছে বলে মন্তব্য করেছেন। ব্যাখ্যা দেবেন?

সোহেল তাজ: শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে, আমার সঙ্গে ও দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ২০০৮ সালের আগে ও পরের শেখ হাসিনার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তিনি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে পরিবর্তন করেছেন। এখন তিনি পলাতক থেকে নেতাকর্মীকে আন্দোলনে ডাকছেন। এখনও এই স্বৈরাচারের আদেশে দল চলছে। কিন্তু এটা হতে পারে না। 

সমকাল : আওয়ামী লীগের সংকটকালে দলের দায়িত্ব নিতে বললে কী করবেন? 

সোহেল তাজ : আওয়ামী লীগ, দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য সারাজীবন আমার বাবা-মা রক্ত-শ্রম দিয়ে লড়াই করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমার বাবা। নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপস না করে তিনি জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আমার মা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যখন আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা ও জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে; অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে– তখন আমি বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারি, তার আগে নয়।

সমকাল : আপনি কি মনে করেন, আওয়ামী লীগ আপনাকে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানাবে?

সোহেল তাজ : না। কারণ, আওয়ামী লীগ তাদের সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। এই সত্তা তারা কবে ফিরে পাবে, কেউ বলতে পারবে না। 

সমকাল : আপনার বোন সিমিন হোসেন রিমি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী-এমপি। তিনি আত্মগোপনে কেন? 

সোহেল তাজ : তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। 

সমকাল : অন্তর্বর্তী সরকারে আমন্ত্রণ জানানো হলে যাবেন কিনা?

সোহেল তাজ: এ মুহূর্তে সরকারে যেতে চাই না। স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে কাজ করছি। এ নিয়েই থাকতে চাই। 

আরও পড়ুন

×