ঐকমত্যের সংলাপ
প্রধানমন্ত্রীর ১০ বছর মেয়াদে শর্তসাপেক্ষে রাজি বিএনপি

লোগো
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫ | ০৫:৫৯ | আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫ | ১০:৫৯
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমলে মেয়াদ নির্ধারণে রাজি নয় বিএনপি। দলটি জানিয়েছে, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকলে তবেই প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ নির্ধারণের প্রস্তাবে সায় দেবে। তা না হলে ‘কেউ জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না’– এ প্রস্তাব সংবিধানে যুক্ত করতে একমত হবে না।
নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে বিএনপির ঘোর আপত্তি থাকায় নতুন প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে প্রস্তাবিত ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠনেও সায় দেয়নি বিএনপি। দলটির ভাষ্য, এনসিসি এবং নিয়োগ কমিটি একই ধরনের। এ ধরনের পর্ষদ হলে নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারের ক্ষমতা কমবে; তাহলে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ নির্ধারণে রাজি হবে না।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংস্কারের দ্বিতীয় দফার সংলাপের ষষ্ঠ দিনে বিএনপি এ অবস্থান নিলেও অধিকাংশ দল প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ নির্ধারণে একমত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ২৩টি দল ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠনেও রাজি।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, অধিকাংশ দল কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপির নামোল্লেখ না করে তিনি বলেছেন, তিনটি দল রাজি হয়নি। আগামী রোববার সংলাপে কমিটির কার্যপরিধি, কীভাবে সাংবিধানিক নিয়োগ হবে– এ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
‘ক্ষমতাধর’ এনসিসির বদলে কমিটি
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিচারপতি, সংসদের উভয় কক্ষের স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত দুই ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধান বিরোধী দল ছাড়া অন্যান্য দল থেকে একজন এমপিকে নিয়ে এনসিসি গঠনের প্রস্তাব করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে– ইসি, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষকের (সিএজি) মতো সাংবিধানিক পদে নিয়োগ হবে এনসিসির মাধ্যমে। ৯ সদস্যের কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দুদক, মানবাধিকার কমিশন, প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানেও নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রস্তাব করা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারও গঠন হবে এনসিসির মাধ্যমে। সংসদ বিলুপ্ত হলেও এনসিসি কার্যকর থাকবে।
বিএনপি এতে রাজি হয়নি। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল এনসিসি গঠনে রাজি হলেও রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে না রাখার বিরোধী ছিল। সরকার যেন স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারে; তাই অ্যাটর্নি জেনারেল, সিএজি এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রাখতে বলে দলগুলো। দলগুলোর ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকারপ্রধানকে দুর্বল করা যাবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর এ অবস্থানের কারণে দুই দিনের বিরতির পর গতকালের সংলাপে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান নিয়োগ কমিটির হাতে থাকবে না। সংসদ ভেঙে গেলে কমিটিও বিলুপ্ত হবে।
প্রস্তাব করা হয়– প্রধানমন্ত্রী, সংসদের উভয় কক্ষের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল বাদে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা অন্য দল থেকে একজন এমপি, রাষ্ট্রপতির একজন প্রতিনিধি এবং প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি হবেন কমিটির সদস্য। ৭ সদস্যের এ কমিটির মাধ্যমে ইসি, দুদক, মানবাধিকার কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হবে।
বিএনপি সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটি গঠনে একমত নয় বলে সংলাপে জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। এর পর ১২ দলীয় জোট, ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ববি হাজ্জাজের এনডিএম, মোস্তাফিজুর রহমানের লেবার পার্টিও জানায়, তারা কমিটি গঠনে রাজি নয়।
বিদ্যমান আইন শক্তিশালী করার পক্ষে বিএনপি
সংলাপের পর বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী না করে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমিয়ে সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা সম্ভব নয়। দুদকসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যদি শক্তিশালী করতে পারি, তা গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ২০২২ সালে আইন করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। দুদকে নিয়োগেও সার্চ কমিটির কথা রয়েছে আইনে। বিএনপি এতদিন আইনগুলোর সমালোচক ছিল। সালাহউদ্দিন আবারও বলেছেন, সরকারের ক্ষমতা খর্ব করবে– এমন পর্ষদ না তৈরি করে আইনগুলোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ যাদের নিয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাদের সমন্বয়েই সার্চ কমিটি গঠনে আইন সংশোধন হলে বিএনপি মানবে কিনা– প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেছেন, ‘এটাও হতে পারে। পরিষ্কার কথা হলো, সাংবিধানিক নিয়োগের বিদ্যমান আইনগুলোর সংস্কার করা হোক। সেখানে নির্বাহী বিভাগের (সরকারের) প্রভাবমুক্ত হয়ে নিয়োগের ব্যবস্থা থাকবে; যেখানে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদে শর্তসাপেক্ষে রাজি বিএনপি
গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সূত্র সমকালকে জানায়, এক ব্যক্তি জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না– সংবিধানে এ বিধান যুক্ত করায় রাজি দলটি। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এনসিসির মতো পর্ষদ গঠনে রাজি হবে না। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা যায়, বৈঠকে সালাহউদ্দিন আহমেদ ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গত কয়েক দিনের সংলাপের রিপোর্ট দেন। গত রোববার সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর পদ দু’বার নাকি দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ করা হবে– এ বিতর্কের মধ্যে বিএনপিই প্রস্তাব করে ঐকমত্যের জন্য বছর নির্ধারণ করা উত্তম হবে। জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন।
তবে সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, এ তথ্য সঠিক নয়। এনসিসির মতো কোনো পর্ষদ হলে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর নির্ধারণে রাজি নয়।
জামায়াত, এনসিপিসহ অন্যরা বিএনপির বিপরীতে
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম সংলাপের পর বলেন, কয়েকটি দল বাদে বাকি সবাই প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ ১০ বছরে সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাবে একমত। সাংবিধানিক নিয়োগে কমিটি গঠনেও একমত।
এবি পার্টির চেয়ারম্যানে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সরকার নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিলে নির্বাচন কোনো দিনই সুষ্ঠু হবে না। সাংবিধানিক নিয়োগ স্বচ্ছ করার প্রস্তাবে যদি ঐকমত্য না হয়, তবে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান হবে।
গণঅধিকার সভাপতি নুরুল হক নুর, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিসহ অন্য নেতারা বলেছেন, ঐকমত্যের স্বার্থে ছাড় দিতে হবে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দলের মধ্যে তিনটি বাদে বাকিরা প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ নির্ধারণে একমত হয়েছে। ঐকমত্যের স্বার্থে এনসিসির পরিবর্তে সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটি গঠনেও রাজি হয়েছে। যারা বিরোধিতা করে সংলাপকে দীর্ঘায়িত করছেন, তাদের কারণেই ঐকমত্য হচ্ছে না।
সংলাপে চিরকুট
কয়েকটি দল সংলাপে বিএনপি যে অবস্থান নিচ্ছে, তাতেই সমর্থন করছে। এলডিপি, লেবার পার্টিসহ কয়েকটি প্রথম দফার সংলাপে এনসিসি গঠনে রাজি ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফার সংলাপে বিএনপির অনুরূপ অবস্থান নিয়েছে। গতকাল সংলাপে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটির পক্ষে বলেন। কিন্তু চিরকুট হাতে পাওয়ার পর তিনিও বিএনপির মতো কমিটি গঠনের বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে হাস্যরস হয় সংলাপে।
সকালে আলোচনা শুরু হয় সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে। মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। বিএনপি, জামায়াতসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক দল মূলনীতিতে আল্লাহর ওপর আস্থা-বিশ্বাস পুনর্বহাল চায়। বাম দলগুলো চায় ধর্মনিরপেক্ষতা। গতকালও মূলনীতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সংলাপে বলেন, ‘আদর্শিক প্রশ্ন হওয়ায় এতে একমত হবে না। যেমন জোনায়েদ সাকিকে ১০ মিলিয়ন ডলার দিলেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিতে রাজি হবেন না। আবার আমাকে ৫০ বিলিয়ন ডলার দিলেও আল্লাহর ওপর আস্থা-বিশ্বাস বাদ দিতে রাজি হব না।’
এ সময় পাশ থেকে কয়েকজন নেতা বলে ওঠেন, নিজের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলার রাখলেও সাকিকে মাত্র ১০ মিলিয়ন দিচ্ছেন কেন? এতে হাসির রোল ওঠে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান ও মো. আইয়ুব মিয়া।
- বিষয় :
- ঐকমত্য কমিশন
- বিএনপি