৬ জোটে ৩৫ বাম দল নির্বাচন প্রশ্নেও বিবাদ

অমরেশ রায়
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৪:৩৫
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান ধারা বিবেচিত বলে বামপন্থি দল ও সংগঠনগুলো বর্তমানে প্রধানত দুটি ধারায় বিভক্ত। স্বাধীনতার পর থেকে বামপন্থি দলগুলো বেশিরভাগই সক্রিয় থাকে শুদ্ধতার প্রশ্নে দলে ভাঙন ও ভাগাভাগি নিয়ে। বর্তমানে একটি অংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে এবং অপর অংশ গণতান্ত্রিক জোটের শরিক হিসেবে 'সক্রিয়' রয়েছে। সব মিলিয়ে ৩৫টি বামপন্থি দল এখন ছয় জোটে বিভক্ত। এর মধ্যে ১০টি বাম দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
বামপন্থিদের ভাষায় 'বুর্জোয়া' শাসকশ্রেণির দল ও জোটের সঙ্গে একমঞ্চে যাওয়া, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, নিজেদের মধ্যকার আদর্শিক মতবিরোধ ইত্যাদি কারণে দেশের বাম জোট ও দলগুলো বারবার ভাঙনের মুখে পড়ছে। আবার কয়েকটি দলকে একীভূতকরণের আলোচনা চললেও খুব বেশি অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। এত ভাঙা-গড়ার মধ্যেও কিছু 'সাফল্য' আছে বলে মনে করেন কোনো কোনো বাম নেতা।
দেশের রাজনীতির এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রধান বাম দলগুলোর অবস্থান বহুমুখী। জোটবদ্ধ দলগুলো কী প্রতীকে নির্বাচন করবে, এ নিয়েও রয়েছে দোদুল্যমানতা। এরই মধ্যে রাজনীতিতে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার জন্য কোনো কোনো বামপন্থি নেতা পুঁজিবাদের ব্যর্থতার জন্য অপেক্ষা করছেন। 'আদর্শ' পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজনে হাজার বছর অপেক্ষা করতেও আপত্তি নেই।
বামদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি- এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি ও বর্ষীয়ান বামপন্থি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি সমকালকে বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেও দুইশ বছর লেগেছে। সামন্তবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কয়েকশ, এমনকি হাজার বছরও লাগতে পারে। এই মুক্তির সংগ্রাম মাত্র শুরু হয়েছে। মানুষের সর্বশেষ ভবিষ্যৎ সমাজতন্ত্রেই। যত দিন যাচ্ছে, পুঁজিবাদের ব্যর্থতা ও দেউলিয়াপনাই প্রকাশ পাচ্ছে- এটাই বাম রাজনীতির সবচেয়ে বড় সফলতা।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান সমকালকে বলেন, ভাঙন কিংবা আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যর্থতার অভিযোগই কেবল বামপন্থিদের রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র চেহারা নয়। মূল কথা হচ্ছে, ভাঙনের মধ্যেও একটা সঠিক নীতি-আদর্শ নিয়ে দলের সাংগঠনিক শক্তির বিকাশ এবং ঐক্যবদ্ধ ক্রমপ্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেটা বাম আদর্শকে আরও শক্তিশালী করছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বামপন্থি কোনো কোনো দলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভাঙন বা বিভক্তি দেখা যাচ্ছে- এটা সত্য। তবে সেটা কিন্তু বামপন্থিদের প্রধান ধারা নয়। বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে জোটগতভাবে বাম গণতান্ত্রিক জোটের উদ্যোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি আছে এবং আরও অগ্রগতি আসবে আশা করা যায়।
প্রাবন্ধিক ও লেখক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সমকালকে বলেন, বামপন্থি দলগুলোকে সবার আগে অতীতের ব্যর্থতার জন্য আত্মসমালোচনা করতে হবে। এরপর বিশ্ব ও বাংলাদেশের বাস্তবতাকে নতুনভাবে ধারণ করে নতুন কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। দেশের রাজনীতি কেমন হবে বা এই রাজনীতিতে করণীয় কী- এসব বিষয়ে দলীয় মতামত ও পরিচ্ছন্ন বক্তব্য ছাপানো পুস্তিকা আকারে দেশবাসীকে জানাতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপকের মতে, দেশবাসীর সামনে পরিস্কার কোনো বক্তব্য না দিয়ে গতানুগতিকভাবে চললে তো কোনো উন্নতি হবে না।
সদ্য সম্পন্ন ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার, জাতীয় নির্বাচনসহ কিছু বিষয়ে 'আপত্তি' সত্ত্বেও ১৪ দলের শরিক নিবন্ধিত বাম দলগুলো এরই মধ্যে নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিয়েছে। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল শরিকরা জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নিলেও আগামী নির্বাচনে জোটের প্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকার থেকে শরিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জোট শরিকদের রাজনীতিতে 'নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর' আহ্বান জানিয়েছিলেন। ফলে আগামী নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের ভূমিকা নিয়ে ধোঁয়াশায় শরিকরা।
গত তিনটি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে অংশ নেওয়া প্রধান দুই শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ আগামী নির্বাচনে নিজ নিজ দলীয় প্রতীকে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, হাতুড়ি প্রতীক নিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ তার দলের দশম কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত। একই মত দিয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। অন্য শরিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি।
শরিক হিসেবে 'অবমূল্যায়ন' নিয়ে বাংলাদেশ জাসদসহ দু'একটি দল বেশ কিছুদিন ধরে জোটের কার্যক্রমে 'নিষ্ফ্ক্রিয়'। শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আসছে। তিনি সমকালকে বলেন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অতীতে অনেক ভূমিকা রাখলেও ১৪ দল এখন গৌরবময় ইতিহাস। এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করতে হবে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দলগুলো নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ, সার্চ কমিটির কার্যক্রম বর্জনসহ নতুন ইসি গঠন আইনের বিরোধিতা করেছে। এখন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার ইস্যুতে রাজপথে 'কঠোর আন্দোলন' গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার এবং তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ জনজীবনের সংকট নিরসনের দাবিতে মার্চ মাস থেকে বিক্ষোভমূলক কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।
এ পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে সিপিবির চার দিনব্যাপী দ্বাদশ কংগ্রেস। 'দুঃশাসন হটাও, ব্যবস্থা বদলাও, বিকল্প গড়ো'- এ স্লোগানে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বিদলীয় মেরূকরণের বাইরে বাম বিকল্প গড়ে তোলার সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় জানিয়েছে তারা। চলতি বছরের যে কোনোদিন 'চলো চলো ঢাকা চলো'র মতো বড় ধরনের কর্মসূচি ঘোষণার কথাও জানিয়েছে দলটি।
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ সংক্রান্ত প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, তারা এই মুহূর্তে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবিতে সংগ্রামে। তাদের কাছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করাটাই জরুরি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে বামপন্থিরা ভালো করতে পারেনি- এমন কথা মেনে নেওয়া যায় না। অবাধ নির্বাচন হোক এবং নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ হোক। তাহলে দেখা যাবে- আদর্শ, ত্যাগ ও জনস্বার্থে কাজ করার প্রতিযোগিতায় সিপিবিসহ বামপন্থিরাই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক অবস্থানে মনে হচ্ছে, ২০১৪ সালের মতো আবারও নির্বাচন বর্জনের পথেই হাঁটছে বেশিরভাগ বাম দল। সে ক্ষেত্রে ২০২৩ সালের শেষভাগ কিংবা ২০২৪ সালের প্রথমভাগে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠে তাদের না-ও দেখা যেতে পারে।
ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে যুক্ত বামপন্থি দলগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল.), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ গণআজাদী লীগ, বাসদ (রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে যুক্ত দলগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।
প্রধান দুই জোটের বাইরে লেখক ও বামতাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ বাম দল ও সংগঠন নিয়ে গড়ে উঠেছে '৯ সংগঠন' নামে আরেকটি জোট। চারটি বাম দল নিয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের শরিকরা হচ্ছে- প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, সাম্যবাদী দল (এমএল), সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) রয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। সাম্যবাদী দলের ক্ষুদ্র একটি অংশ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের 'নামকাওয়াস্তে' শরিক হিসেবে যুক্ত। এর বাইরে গণফ্রন্টসহ কিছু নামসর্বস্ব বামপন্থি দল ও জোটের অস্তিত্ব রয়েছে।