অস্ট্রেলিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ-২০২৪
ফাইনালে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো টিম অ্যাটলাস

টিম অ্যাটলাসের সদস্যরা ছবি : অনলাইন
ইমদাদুল হক
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৪ | ০৬:০৪ | আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৪ | ১৫:১৯
২০১৫ সালের ৯ মার্চ, বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্বর্ণখচিত দিন। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ওভালে টাইগার পেসার রুবেল হোসেনের ইয়র্কার সামলাতে ব্যর্থ হন জেমস অ্যান্ডারসন। বল স্টাম্পে আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে বুনো উল্লাসে মাতেন রুবেল, সঙ্গী সতীর্থরা। এর মাধ্যমেই টি২০ বিশ্বকাপের অষ্টম আসরে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার নজির গড়ে বাংলাদেশ। অ্যাডিলেডে ঘটে যাওয়া সেই স্মরণীয় ঘটনার ঠিক ৯ বছরের মাথায়, গত ২৪ মার্চ অ্যাডিলেডে আবারও উড়ল লাল-সবুজের পতাকা। তবে এবার উল্লাসে মাতলেন টাইগার রোবট নির্মাতারা। ক্রিকেটের পর রোভার প্রকৌশল চ্যালেঞ্জে শীর্ষ দশে নাম লেখাল সানি জুবায়েরের দল টিম অ্যাটলাস। অ্যাটলাস মার্স রোভার কেবল বাংলাদেশের হয়ে নয়, এই উপমহাদেশের মধ্য থেকে অনন্যতা লাভ করেছে।
অস্ট্রেলিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ-২০২৪
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেডে বসা এবারের মার্স রোভারভিত্তিক এই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশ থেকে জমা পড়া শতাধিক প্রকল্পের মধ্যে ১৪টি প্রকল্প ডাক পায় মূল আসরে। ১৫০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার বাজেটের মধ্যে সত্যিকার চন্দ্রাভিযানের মতো মিশন সম্পন্ন করার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথমবারেই নবম স্থানে ওঠে লাল-সবুজের পতাকাবাহী মঙ্গলযান ‘অ্যাটলাস মার্স রোভার’। প্রতিযোগিতার প্রথম আসরেই এমন সাফল্য ছিল অবিশ্বাস্য। সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে টিম অ্যাটলাস দলনেতা সানি জুবায়ের বলেন, ‘শুরুতে অনেক দেশ আমাদের গণনাতেই ধরেনি। কিন্তু যখন আমরা স্কোরবোর্ডে ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম, তখন স্কোর প্যানেল ও জাজ প্যানেল থেকে বারবারই একটি কথা বলা হচ্ছিল– এত কম সময়ে রোভারের নকশায় এটি সত্যিই প্রকৌশল খাতে বড় ধরনের একটি প্রচেষ্টা। এটি প্রকৌশলের অভিনবত্ব।’
কী সেই অভিনবত্ব– জানতে চাইলে দেশে ফেরার ফ্লাইটে চড়েই সানি বললেন, ‘আমরা এমন কিছু হালকা ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করেছি, যা তাদের ধারণার অতীত। কেননা মার্স রোভার যত হালকা হবে, মোবিলিটি বেশি হবে ততই বেটার। সেদিক থেকে আমরা এগিয়ে যাই। এখন পর্যন্ত মোবিলিটি ও স্পিডে আমরা রেকর্ড গড়ি।’
যাদের সঙ্গে লড়াই
পোল্যান্ড দলসহ আসরে দশম স্থান লাভ করা স্বাগতিক ইউনিভার্সিটি অব ওলোগোং-কে ২০ পয়েন্টে পিছিয়ে এ অবস্থান নিশ্চিত করেছে টাইগাররা। পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশী ভারতের ইউনিভার্সিটি অব দিল্লি; আইআইটি; ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনিকেও। প্রতিযোগিতায় সেরাদের সেরা হয়েছে প্রজেক্ট স্করপিও। এর পরের অবস্থানগুলোতে রয়েছে মোনাস নোভা রোভার। ইউকিউ স্পেস, কিউইউটি রোবটিক ক্লাব, অ্যাডিলেড রোভার টিম, ইউনিমেলব রোভার টিম, আরএমআইটি রোভার টিম এবং স্যুইন বুর্নে রোভার টিম।
চ্যালেঞ্জ বিজয়ীরা
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ১৪টি দলের মধ্যে টিম অ্যাটলাসই নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একত্র হয়ে গড়ে তোলা একটি দল। এই দলের সদস্যরা হলেন– ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সানি জুবায়ের (দলনেতা) ও জান্নাতুল ফেরদৌস ফাবিন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাহতাব নেওয়াজ (টিম ম্যানেজার), শিহাব আহমেদ অনন্ত, মো. আদহাম ওয়াহিদ ও মোহাম্মদ সাদমান ওয়াসিফ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের নুর হোসেন আসিফ, বিএএফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলার মো. তানজীর আরাফাত, দাউদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের আতিক শাহারিয়ার হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. ফাহিম শাহরিয়ার ও বিএএফ শাহীন কলেজের মোহাম্মদ মেহরান ইসলাম মাহিম।
ঘুমহীন চার দিন ও জাতীয় সংগীত…
পূর্ণ-স্কেলের এই লুনার মিশনে যাওয়ার আগে জানুয়ারি থেকে শুরু হয় প্রস্তুতি। সিলেকশন রাউন্ডের প্রথম ধাপে টিম অ্যাটলাস রোভার ডিজাইন ও কার্যপ্রণালি এবং গবেষণাপত্র জমা দিয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ডিজাইন অনুযায়ী রোভার তৈরি, ফিল্ড টেস্টে অংশ নেওয়া এবং ভিডিও রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এ ছাড়া দিতে হয়েছে বেশ কিছু পরীক্ষা। চার দিনব্যাপী এই প্রতিযোগিতায় উদ্ভাবক প্রকৌশলীদের একটি কিবোর্ড দেওয়া হয়। সেই কিবোর্ডে রোবটের মাধ্যমে কয়েকটি নির্দিষ্ট নম্বর লিখতে হয় প্রতিযোগীদের। এরপর আরএফআইডিতে দেওয়া হয় গুপ্ত কোড। রোভারটি সেই কোড ক্যাপচার করে এক্সট্র্যাক্ট করে জানতে পারে তার মিশন সম্পর্কে। মূলত মঙ্গল গ্রহে যখন রোভারগুলো চলবে, তখন যেন এগুলো কতটা দক্ষতার সঙ্গে কেবল কানেকশন, পাইপ জয়নিং ও কেবলিংয়ের কাজ করতে পারে তার দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় দিনে অ্যাটলাস রোভারের মাধ্যমে মাটি খুঁড়ে খনিজ উদ্ধার করে সেগুলোর পরিচয় শনাক্ত করেছে। তৃতীয় দিনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এবং লুকিয়ে থাকা পাথর খুঁজে বের করে ছবি তুলেছে ও সংগ্রহ করেছে। চূড়ান্ত দিনে কোনো সাহায্য ছাড়াই রোভারটিকে নিজে থেকেই গভীর বালুর স্তূপে চলতে চলতে লুকিয়ে থাকা পাথরের আকার-আকৃতি ও অবস্থান বের করতে হয়েছে। এদিনেই এক ধাপে ২০ নম্বর বেশি পেয়ে নবম অবস্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ। বদলে যাওয়া এ স্কোরবোর্ডে চোখ রেখে খেলোয়াড় থেকে শুরু করে নাসার বিজ্ঞানী, বোয়িংয়ের মতো ডাকসাইটে কোম্পানি প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও গবেষক দর্শকরা অবাকই হয়েছেন। স্কোরবোর্ডে শীর্ষ ১০ দলের ছবির সঙ্গে উড়তে থাকে লাল-সবুজের পতাকা। নিয়ম অনুযায়ী, বিজয়ী দলের সঙ্গে উপস্থিত সবাই গাইলেন– ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’।
আগামীর স্বপ্ন ও কৃষিতে প্রযুক্তি ভাবনা
আলাপকালে কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের ভরা ভাদরের নতুন স্বপ্ন বুনতে বুনতে দলনেতা সানি জুবায়ের বললেন, ‘কৃষিতে রোবটের টেকসই ব্যবহার নিয়ে এখন আমরা কাজ করছি। প্রায় চার মাসের পরিশ্রমে যে অর্জন আজ করলাম, আশা করি সব বাধা দূর করে একদিন আমরাই চাষাবাদের অনন্য রোবটিক সল্যুশন নিয়ে হাজির হবো বিশ্বে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সাথি রোবট বানিয়ে রোবটিকসে নেতৃত্ব দেবো ইনশাআল্লাহ।’
সেই প্রতীক্ষায় থাকলাম আমরাও!
- বিষয় :
- প্রকৌশলী