যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে ব্যথানাশক আসক্তি মোকাবিলায় গবেষণা
মাহমুদুলের নেতৃত্বে সাফল্য

.
আশিক মুস্তাফা
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:০০
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ওপিওয়েড ওষুধে আসক্ত রোগীদের কীভাবে সফল চিকিৎসা দেওয়া যায় তা নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার একদল গবেষক। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান। তরুণ এ গবেষকের নাম উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তাঁর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে বিস্তারিত তুলে এনেছেন আশিক মুস্তাফা
যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ওপিওয়েড ওষুধে আসক্তি জটিল জনস্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কীভাবে এর সফল চিকিৎসা দেওয়া যায় তা নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার একদল গবেষক। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে তাঁর নাম। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দুটি বিভাগে অধ্যাপনা করা প্রথম বাংলাদেশি এ তরুণের গবেষণায় পিএইচডি করতে যুক্ত হয়েছেন খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ইরানের একজন শিক্ষার্থীও এই গবেষণায় যুক্ত আছেন। চলুন, তাঁর গল্প শুনি–
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
শৈশবের কথা জানতে চাইলে মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘দ্বীপ জেলা ভোলায় আমার জন্ম। এখানেই শৈশব ও বেড়ে ওঠা। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ফেরা মানুষগুলোই আমাকে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছেন। বাবা ব্যাংকার ছিলেন। মা গৃহিণী। বাবা আমার প্রথম বন্ধু। আমি যেহেতু মা-বাবার একমাত্র সন্তান, তাই তাদের ভালোবাসার মধ্যমণি হয়ে থাকলেও আমাকে কখনও তারা কোনো কাজে আটকাননি। বরং উৎসাহ দিয়েছেন। মা খেয়াল রাখতেন পড়াশোনায় আমার মনোযোগ যেন ব্যাহত না হয়। শুধু তাই নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সামাজিকতা, আবৃত্তি এবং সর্বোপরি সব ধরনের সফলতার পেছনে বড় অবদান মায়ের; একই সঙ্গে বাবারও। খেলাধুলার প্রতি প্রবল আগ্রহ আমার শৈশব থেকেই। সব ধরনের খেলাধুলায় আগ্রহী হলেও, আমার প্রধানতম পছন্দের খেলা ক্রিকেট, ফুটবল আর টেনিস। মাগরিবের আজানের আগে খেলা শেষ করে নামাজ পড়ে বাসায় গিয়ে কিছু খেয়ে আবার পড়তে বসা। এই ছিল রুটিন।’
গ্রামের স্কুল, নটর ডেম-বুয়েট হয়ে যেভাবে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে
পড়াশোনার শুরুটা কোথায়, কীভাবে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে আর কেন শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিলেন– এ প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘গ্রামের স্কুলের শিক্ষকদের স্নেহে শুরু আমার শিক্ষাজীবন। কবিতা পড়তে ভালো লাগত। স্কুলজীবনে ভোলা আবৃত্তি সংসদের সদস্য ছিলাম। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে আগ্রহী করত। মাধ্যমিক পরীক্ষার সাফল্য আমাকে নটর ডেম কলেজে নিয়ে আসে। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হয়ে সেখান থেকে কলেজে সায়েন্স ক্লাবের সদস্য হলাম। নটর ডেম থেকে পরের গন্তব্য বুয়েট। ২০০৮ সাল থেকে বুয়েট যাত্রা শুরু। বুয়েটে পড়াকালীন সিদ্ধান্ত নিই শিক্ষকতা আর গবেষণাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার। ২০১৩ সালে মাস্টার্স শুরু করি বুয়েটে। একই সঙ্গে আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে প্রভাষক হিসেবে শুরু করি কর্মজীবন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমার শিক্ষকজীবনের সূচনা এখান থেকেই। এখানেই সিদ্ধান্ত নিই উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের। ২০১৬ সালে আমেরিকার বোস্টনে নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে আসি।’
গবেষণার বিষয় এবং আমাদের দেশের বাস্তবতা
মাহমুদুল বলেন, ‘এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ওপিওয়েড ড্রাগ অ্যাডিকশন প্রোতিরোধ করার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে আমার গবেষণা শুরু। ওপিওয়েড ড্রাগ অ্যাডিকশন বলতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যথানাশক কিংবা বিভিন্ন রোগের স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি উপশমকারী ওষুধের প্রতি মানুষের আসক্তিকে বোঝায় যে, কীভাবে ব্যথা উপশমকারী ওষুধ মানুষের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে। যারা ওপিওয়েড মানে ব্যথানাশক কিংবা এ ধরনের রোগের ওষুধ গ্রহণ করে তারা ওপিওয়েড ব্যবহারজনিত আসক্তির ঝুঁকিতে থাকে, যাকে ওপিওয়েড আসক্তি বলা হয়। লম্বা সময় ব্যবহার করলে আসক্তির ঝুঁকি বাড়ে। তখন অল্প ওপিওয়েড নিয়ে আর কাজ হয় না। চাহিদা বেড়ে যায়। এতে মানুষ বেশি করে মাত্রাতিরিক্ত ওপিওয়েড নেওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে ওভারডোজের ঝুঁকি বাড়ে এবং সঙ্গে ওভারডোজজনিত মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে। আমাদের দেশে মাথাব্যথা হলেই অনেকে নাপা বা টাফনিল খেয়ে ফেলে। ওষুধটা প্রথম প্রথম আপনার ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করলেও, পরবর্তী সময়ে সামান্য ব্যথাতেও আপনি অবচেতন অভ্যাস বা আসক্তিবশত ওষুধটা সেবন করতে থাকবেন। আমেরিকাসহ পৃথিবীর আরও বেশ কয়েকটি দেশে ওপিওয়েড অ্যাডিকশন একটি খুব জটিল জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৩০ জনের বেশি আমেরিকান ওপিওয়েড ড্রাগ অ্যাডিকশনজনিত কারণে প্রাণ হারায়। শুরু থেকেই এ গবেষণা আমার ভালো লাগতে শুরু করে এবং আমি গবেষণার কাজ খুব উপভোগ করতে থাকি। এরপর চেষ্টা করতে থাকি কীভাবে এআই ব্যবহার করে চিকিৎসক রোগীদের ওপিওয়েড অ্যাডিকশন ট্রিটমেন্ট আরও সফলভাবে দিতে পারেন।’
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে দুই বিভাগে অধ্যাপনা
মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমেরিকায় ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানের বিষয়টি ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক। কয়েক ধাপের ইন্টারভিউয়ের পর ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডায় অধ্যাপনার সুযোগ পাই। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আমি মূলত দুটি বিভাগে অধ্যাপনা করছি। ফার্মাসিউটিক্যালস আউটকাম অ্যান্ড পলিসি এবং ইনফরমেশন সিস্টেমস অ্যান্ড অপারেশনস ম্যানেজমেন্ট। এ দুটি বিভাগে অধ্যাপনার জন্য প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমি যোগদান করি।’ মাহমুদুল হাসান আরও বলেন, ‘আমার গবেষণা দলে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং এপিডেমিওলজিস্ট আছেন, যারা বিভিন্নভাবে আমার গবেষণা এগিয়ে নিতে সাহায্য করছেন। সম্প্রতি আমার গবেষণায় পিএইচডি করতে যুক্ত হয়েছে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ইরানেরও একজন শিক্ষার্থী এ গবেষণায় যুক্ত আছে।’
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘রোগীর রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইর ব্যবহার নিয়ে আমি বাংলাদেশেও গবেষণা করতে আগ্রহী। আমার মনে হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করার জন্য প্রযুক্তির বিকল্প নেই। প্রায়ই শুনতে হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাদের দেশের মানুষকে অন্য দেশে ছুটতে হচ্ছে। এ জায়গাটায় আমার গবেষণা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নততর করতে সহযোগিতা করতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের সঙ্গে কাজ করতে চাই আগামীতে।’ আমরাও চাই, মাহমুদুলদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ!
- বিষয় :
- সাফল্য অর্জন