ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জুনিয়র এশিয়া কাপ হকি

নতুন তারকা মেহরাব

নতুন তারকা মেহরাব

মেহরাব হোসেন সামিন ছবি : সংগৃহীত

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২১

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলের অধিনায়ক মেহরাব হোসেন সামিন। তাঁর হাত ধরে প্রথমবার জুনিয়র হকির বিশ্বকাপে জায়গা করে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ। ওমানের মাসকটে সদ্য শেষ হওয়া জুনিয়র এশিয়া কাপ হকি থেকে এ অর্জন বয়ে নিয়ে আসা ও নিজের স্বপ্নের কথা আশিক মুস্তাফা-কে শুনিয়েছেন হকির নতুন এই তারকা

প্রথমবার জুনিয়র হকির বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের হকির ইতিহাসে যেটি সবচেয়ে বড় অর্জন। এ অর্জন এসেছে যার হাত ধরে তাঁর নাম মেহরাব হোসেন সামিন। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলের অধিনায়কের কাছে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপে খেলার আত্মবিশ্বাসটা আমাদের সেদিনই তৈরি হয়েছিল, যেদিন এএইচএফ কাপে আমরা চীনকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। সবার মধ্যে তখন আত্মবিশ্বাস চলে আসে। সতীর্থদের অনেকে বলেছিলেন, আমরা যখন চীনের মতো শক্তিশালী দলকে হারাতে পেরেছি, অবশ্যই চেষ্টা করলে এশিয়া কাপেও ভালো একটা ফল পাব। এরপর আমরা চেষ্টা করেছি। তার ফলও পেয়েছি।’ 
হকির দুঃখ 
তবে এই সাফল্যের পরও মেহরাব হোসেন সামিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের বাবা-মায়েরা মনে করেন, সন্তান খেলাধুলা করে, একসময় অনেক টাকা পাবে। হকির ক্ষেত্রে বাস্তব চিত্র আসলে ভিন্ন। হকিতে টাকা নেই বললেই চলে। আমাদের কোনো পৃষ্ঠপোষক ছিল না। দৈনিক ভাতা মাত্র ৪০০ টাকা। অথচ হকির একটা বুট কিনতে গেলে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে। এরপর আমাদের এ পর্যায়ে খেলতে যে হকিস্টিক লাগে, সেটিরও দাম ১৮ থেকে ২০ হাজার করে। একটি লেভেল পর্যন্ত সম্মানী বাড়িয়ে দিলে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের হকি। তবে আশা করি দ্রুত এর সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ!’ 
জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং যেভাবে হকিতে
মেহরাব হোসেন সামিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুলনাতেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই ছিলাম ডানপিটে! খেলাধুলা ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। যদিও এর জন্য অনেক বকুনি খেয়েছি বাবা-মায়ের কাছে; তবু খেলা ছাড়িনি। বড় ভাইয়ের বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম। তবে তখন হকি খেলতাম না; ক্রিকেটই বেশি খেলতাম। এলাকার যে কোনো টুর্নামেন্টে ডাক পড়ত আমার। খেলতাম বড় ভাইদের সঙ্গে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়তাম। মনে পড়ে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে অনেক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলেছি। কখনও আবার স্কুল শেষে গিয়েছি খেলতে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলে বলতাম– স্কাউটের ক্লাস ছিল, তাই দেরি হয়ে গেছে। তবে মা ঠিকই বুঝতেন। আমি যে স্যারের কাছে কোচিং করতাম, তিনি খুব সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। পড়াশোনা ছাড়া তেমন কিছু পছন্দ করতেন না। খেলাধুলা তো বলা যায় স্যারের দু’চোখের বিষ! তবে সেই স্যারকে ফাঁকি দিয়ে বিকেল হলেই আমি নিয়মিত খেলতে যেতাম। এর জন্য ধরা খেয়ে স্যারের কাছে মারও খেয়েছি।
একসময় বাবা বুঝতে পারেন, এই ছেলে যেহেতু খেলাধুলা ছাড়া কিছুই বুঝতে চায় না, তাকে বিকেএসপিতে দিয়ে দিই। তো, বাবা একদিন বললেন, তুমি বিকেএসপিতে ভর্তি হবা? বললাম, সেটি আবার কী? বাবা বললেন, অইখানে সবাই খেলাধুলার জন্য যায়। তুমিও চাইলে যেতে পারবে। তবে সেখানে তোমাকে একা থাকতে হবে। অনেক কষ্ট করতে হবে। কোনো ভাবনা ছাড়াই বলে দিলাম, আমি যাব।
বাবা জানতে চান, খারাপ লাগবে না আমাদের ছেড়ে থাকতে?
বললাম, আমি অইখানে গিয়ে কষ্ট করে একদিন বড় কিছু হতে পারলে তোমরা সবাইকে বড় মুখ করে বলতে পারবে, আমার ছেলে পরিবার ছেড়ে একাকী থেকে অনেক কষ্ট করে আজ এই পর্যন্ত এসেছে। এর পর আমার বড় ভাই বিকেএসপির ট্রায়ালে নিয়ে গেলেন। কপাল খারাপ হলে যা হয়! আমরা গিয়ে দেখি, ক্রিকেটের ট্রায়াল শেষ। সুযোগ আছে কেবল হকিতে। কী আর করা, আমি হকিতে ট্রায়াল দিয়ে নির্বাচিত হয়ে যাই। ডাকা হয় সাত দিনের ক্যাম্পে। সেখানে প্র্যাকটিস ট্রেনিংয়ের পর চূড়ান্তভাবে বিকেএসপিতে ভর্তি হই ২০১৪ সালে।  
বিকেএসপি থেকে জাতীয় দলে
বিকেএসপির দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে মেহরাব হোসেন সামিন বলেন, বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া খুব সহজ ছিল না। টাকাও ছিল না বাবার কাছে। চাচার সহযোগিতায় বিকেএসপিতে ভর্তি হই। ২০১৪ সালের মার্চ থেকে আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই বিকেএসপিতে। এখানকার ট্রেনিং আমার জন্য খুব কষ্টের ছিল। পারতাম না ঠিকঠাক। তবে আস্তে আস্তে নিজেকে নিজেই সাহস দিতে থাকি এই বলে যে, আমি যদি এখান থেকে ফিরে যাই, তবে বাবা-মা কেমন করে পাড়ায় মুখ দেখাবেন? আমিও কেমন করে চলব বন্ধুদের মাঝে? এসব ভেবে ঠিক করি, যত কষ্টই হোক, পিছু হটব না। এর পর অনেক কষ্ট করতে থাকি। ভাগ্যিস এর মধ্যে আমাদের ট্রেইনার হিসেবে যোগ দিলেন বিপ্লব স্যার। আসলে তখন পর্যন্ত আমার গ্রুপের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র ছিলাম আমি। বিপ্লব স্যার প্রথম ক্লাসে সবার সঙ্গে পরিচিত হলেন। সবার কাছে জানতে চাইলেন, কে কতদিন ধরে হকি খেলে। সবাই বলল। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ, আমি তো মাত্রই শুরু করলাম। তা ছাড়া ক্রিকেটের ট্রায়াল না দিতে পেরে আমি যে হকিতে এসেছি, সেটি ক’জনই বা জানে! সে যাক, তো স্যার আমাকে বললেন, সামিন, তুমি তো নতুন। এক কাজ করো, আমাকে কপি করো। অন্যদের একটা স্টাইল আছে। তোমার কোনো স্টাইল নেই। তাই কপি করা তোমার জন্য সহজ হবে। আমি তাই করতে থাকলাম। অনেক কষ্ট করি তখন। একটা সময় আমি ভালো করতে থাকি। ২০১৬ সালের কথা। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। লিগ খেলার জন্য খেলোয়াড় নেবে ৩২ জন। বিকেএসপিতে আমার পার্টনার ছিলেন নাহিয়ান শুভ ভাই। তিনি আর আমি সব সময় অনুশীলন করতাম। অতিরিক্ত অনুশীলনও করতাম তাঁর সঙ্গে। একদিন শুভ ভাই আমাকে বললেন, সামিন খেলোয়াড় নেবে। চল, চেষ্টা করি দু’জন। আমরা দু’জন চেষ্টা করতে করতে ফাইনালি লিগ 
খেলায় দুইজনের নাম চলে আসে। সেই থেকে শুরু ঢাকা স্টেডিয়ামের যাত্রা! 
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে মেহরাব হোসেন সামিন বলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভারতে বিশ্বকাপ। এখনও প্রায় এক বছর সময় বাকি। আপাতত সেই বিশ্বকাপ খেলাটাই স্বপ্ন। এ ছাড়া ভালো খেলে ভবিষ্যতে মূল জাতীয় দলে, মানে সিনিয়র দলে খেলা এবং দলের দায়িত্ব পালন করতে চাই। আর সিনিয়র টিমে খেলার পাশাপাশি বিশ্বকাপে খেলতে চাই এবং অলিম্পিকও খেলতে চাই। এ ছাড়া বাংলাদেশ হকি দলকে আরও অনেক বড় জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। এটাই দেখাতে চাই যে, সবাই বাংলাদেশকে ঈর্ষার চোখে দেখবে! 

আরও পড়ুন

×