ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

সমুদ্র থেকে হিমালয় অন্য এক যাত্রার গল্প

সমুদ্র থেকে হিমালয় অন্য এক যাত্রার গল্প

এভারেস্টের চূড়ায় লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে ইকরামুল হাসান শাকিল নিজ জন্মভিটায় ফিরে আসার খবরে শনিবার আশপাশের গ্রামের মানুষ ছুটে আসেন তাঁর কুটিরে। কারও হাতে তাজা ফুলের তোড়া, কারও হাতে মালা। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বাগচালা গ্রামে 3 ছবি : ইজাজ আহ্‌মেদ মিল

গাজী মুনছুর আজিজ

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫ | ০০:৪৬

এভারেস্টজয়ী শাকিলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) মাসিক মিটিংয়ে। তিনি সেই মিটিংয়ে তাঁর একটি সাইকেল অভিযানের স্লাইড শো দেখিয়েছেন। সম্ভবত অভিযানটি ছিল ঢাকা থেকে সাইকেল চালিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি যাওয়া। স্লাইড শোতে তিনি অভিযানটি কীভাবে শুরু করেছেন, পথে কোথায় থেমেছেন, কী কী করেছেন ইত্যাদি বর্ণনা তুলে ধরেছেন ছবির মাধ্যমে। মূলত সেদিনই তাঁর মধ্যে দেখলাম অদম্য শক্তির প্রতিফলন, স্বপ্নজয়ের আভা। এরপর ক্লাবের মিটিংয়ে তাঁর আরও অনেক অভিযানের স্লাইড শো দেখি এবং প্রতিবারই মুগ্ধ হই তাঁর অভিযান জয়ের গল্প শুনে, কিংবা স্বপ্নজয়ের আকাঙ্ক্ষা দেখে। এখন এভারেস্ট জয়ের মাধ্যমে তাঁর সেই স্বপ্নের কথা কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়ার সামনে হাজির।
শাকিল কেবল এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখেননি; বরং দেশের মানুষকে, পৃথিবীর মানুষকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। সেটি হলো– কেবল ইচ্ছা থাকলেই যেকোনো স্বপ্ন জয় করা সম্ভব এবং তিনি সেটি করে দেখিয়েছেন।
সপ্তম বাংলাদেশি হিসেবে ইকরামুল হাসান শাকিল এভারেস্টচূড়ায় উঠেছেন।  অন্য এভারেস্টজয়ীদের গল্পের সঙ্গে তাঁর গল্প একটু আলাদা। অন্যরা এভারেস্টচূড়ায় ওঠার অভিযান শুরু করেন নেপাল থেকে। শাকিল অভিযান শুরু করেন কক্সবাজারের ইনানী সৈকত থেকে। সেজন্য তাঁর অভিযানের নাম ‘সি টু সামিট’। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখর মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া। এজন্য তিনি হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার পথ। শুধু হেঁটে নয়, পথে যমুনা নদী সাঁতার কেটে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ৯০ দিনের ভেতর অভিযান সম্পন্ন করা। তার আগেই ৮৪ দিনের মাথায় তিনি পৌঁছে যান ৮ হাজার ৮৪৮ দশমিক ৮৬ মিটার উঁচু শিখরে। এর মাধ্যমে তিনি গড়েছেন অনন্য এক রেকর্ড। কেবল রেকর্ড নয়, অদম্য সাহস এবং ইচ্ছার এক বিরল দৃষ্টান্ত হাজির করেছেন বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের সামনে।
এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইনানি থেকে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল পেরিয়ে ১৯ মে ভোরে পৌঁছে যান এভারেস্টশৃঙ্গে। তিনি দেখিয়েছেন, কেবল সাহস আর বিশ্বাসে ভর করে যেকোনো শৃঙ্গই জয় করা সম্ভব। 
তাঁর এ অভিযান কেবল এভারেস্ট জয়ের জন্যই নয়, পাশাপাশি পরিবেশবাদী বার্তা ছড়ানোর এক দৃঢ় প্রচেষ্টাও ছিল। শাকিল বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে সমুদ্র থেকে পর্বতশৃঙ্গ পর্যন্ত প্লাস্টিকদূষণের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। আমরা এখনই যদি কিছু না করি, হয়তো এমন দিন আসবে যখন এভারেস্ট থাকবে না, থাকবে না চলার পথ, থাকবে না নিঃশ্বাস নেওয়ার বাতাসও।’
শাকিলের আরেকটি বার্তাও প্রেরণাদায়ক। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এভারেস্ট জয় করতে পারি, তবে নিজের ভেতরের অসচেতনতাও জয় করতে পারব।’
ভিন্ন উপায়ে এভারেস্ট জয় ও পরিবেশ বার্তার পাশাপাশি শাকিল গড়েছেন নতুন রেকর্ড। বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বলেন, এর আগে অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যাকহার্টনি-স্নেইপ ১৯৯০ সালে ভারতের গঙ্গাসাগর থেকে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার হেঁটে তিন মাসের বেশি সময় নিয়ে এভারেস্টের শিখরে পৌঁছান। শাকিল স্নেইপের সেই রেকর্ড ভেঙে আরও কম সময়ে আরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে শিখরে পৌঁছান।
শাকিলের সবচেয়ে বড় বার্তাটি ছিল স্বপ্নবাজ তরুণদের প্রতি; যারা স্বপ্ন দেখছেন বা দেখতে চান। শাকিল বলেন, ‘আমি এভারেস্টচূড়ায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছি আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় ও দায়িত্ববোধে। এ আরোহণ শুধু আমার একার নয়। এটি আমার দেশের, আমার মানুষদের, আর সেই সকল তরুণের যারা আজও স্বপ্ন দেখে নিজের সীমা ভেঙে কিছু করে দেখানোর।’
অবশ্য চূড়ায় ওঠার পথ যে সহজ ছিল না সে কথা শাকিল একাধিকবা বলেছেন। তিনি বলেন, ১৯ মে ২০২৫। সকাল সাড়ে ৬টা। আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। মাথার ওপরে বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল, প্রকৃতি সেটি চায়নি। চেয়েছিল কঠিন পরীক্ষা। পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন পর্বতারোহী নই–আমি তখন হাজারও আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি।
শাকিল লিখেন, এ পথ সহজ ছিল না। হিমালয়ের অতল গভীর বরফের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আমাদের জীবনবিন্দু। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য। যমুনা নদীর উত্তাল স্রোত আর ঢেউ, অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথ, খুম্বু আইসফল, লোৎসে ফেস, সাউথ কল, হিলারি স্টেপ– একেকটা জায়গা যেন একেকটা মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র ও মৃত্যুর চোখ রাঙানি। অক্সিজেনশূন্য উচ্চতায় কৃত্রিম অক্সিজেন মাস্কবদ্ধ মুখে প্রতিবারই মনে হয়েছে, ‘আর পেরে উঠব না।’ কিন্তু হৃদয়ে বাজতে থাকা বাংলাদেশের নাম আর ‘সি টু সামিট’ অভিযানের অঙ্গীকার আমাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
চূড়ায় উঠে শাকিল তাঁর অভিযানসঙ্গী ও বন্ধু তাশি গ্যালজেন শেরপার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। চলতি মৌসুমে তাশি ১৫ দিনে চারবার এভারেস্ট জয় করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। বছর দুয়েক আগে তারা দু’জনে পরিকল্পনা করেছিলেন একসঙ্গে দুটি রেকর্ডময় অভিযান করব। তারা সেটি করেছেন। শাকিল ‘সি টু সামিট’ আর তাশি ১৫ দিনে চারবার এভারেস্ট সামিট।
নিজের শক্তি ও সামর্থ্য ছাড়াও এ জাতীয় অভিযান সফল হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পৃষ্ঠপোষকরা। শাকিলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রাণ, ইউএনডিপি, মাকালু ই ট্রেডার্স, সিস্টেমা টুথব্রাশ, মি. নুডলস, অদ্রি, সাকেব নাজিম (শুভ্র) প্রমুখ। চূড়ায় উঠে শাকিল তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে ভোলেননি। আগামী বছর আমাদের ক্লাবের আরেক সদস্য কাজী বিপ্লব এভারেস্ট সামিটের পরিকল্পনা করছেন। আশা করি তাঁর বেলাতেও পৃষ্ঠপোষকরা এগিয়ে আসবেন।
শাকিলের আগে আমাদের ক্লাবের এম এ মুহিত দুইবার, দেশের প্রথম নারী হিসেবে নিশাত মজুমদার এবং সজল খালেদ এভারেস্ট জয় করেন। অবশ্য সজল খালেদ এভারেস্ট জয় করে আর আমাদের কাছে ফিরে আসেননি। এভারেস্টের কোলেই ঘুমিয়ে আছেন অনন্তকালের জন্য। আশা করি আগামী বছর কাজী বিপ্লব সফলভাবে এভারেস্ট জয় করবেন।
বাংলাদেশের তরুণরা এভারেস্ট জয় করবেন, এ স্বপ্ন যিনি দেখেছেন, এ পথ যিনি দেখিয়েছেন তিনি বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক। শাকিলের বিশ্বরেকর্ড গড়ার গল্প যারা শুনেছেন, আমি মনে করি ইনাম আল হকের গল্পটাও তাদের জানা উচিত। স্যালুট, ইনাম আল হক। আজ আপনার জন্যই আমাদের তরুণরা এভারেস্টের শিখরে উঠেছেন, উঠছেন এবং উঠবেন। u

আরও পড়ুন

×