ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

আগামী দিনে অসংখ্য নারী আম্পায়ারের দেখা পাবে বাংলাদেশ

আগামী দিনে অসংখ্য নারী আম্পায়ারের দেখা পাবে বাংলাদেশ

সাথিরা জাকির জেসি

সাথিরা জাকির জেসি

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩২

২৫ এপ্রিল মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেটে সুপারলিগের ম্যাচে আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্ব পালনের পর আমাকে নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা। আমি ডিপিএলের ইতিহাসে প্রথম কোনো নারী আম্পায়ার হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করি। শুধু তা-ই নয়; গেল ১০ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগে থাইল্যান্ড বনাম মিয়ানমার ম্যাচ দিয়ে দেশের প্রথম নারী আম্পায়ার হিসেবে আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়। আমার আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার মূলত অফিসিয়ালি ২০২২ সালে শুরু। স্কুল ক্রিকেট, থার্ড ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, ফার্স্ট ডিভিশন, লঙ্গার ভার্সন ছেলেদের এবং মেয়েদের খেলা পরিচালনা করেছি অনেক। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্টে সুযোগ পাই রিজার্ভ এবং অনফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে। দুর্ভাগ্যবশত বৃষ্টির কারণে সেই সিরিজে অনফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে মাঠে আমার আন্তর্জাতিক অভিষেকটা হয়ে ওঠেনি। এর আগে ভারত-বাংলাদেশ ও পাকিস্তান-বাংলাদেশ সিরিজে রিজার্ভ আম্পায়ার হিসেবে ছিলাম। এ ছাড়া লেজেন্ড লিগ থেকে শুরু করে ভারতের বেশ কয়েকটি বড় টুর্নামেন্টেও আম্পায়ারিং করেছি।
ছোটবেলায় বড্ড ডানপিটে ছিলাম আমি। দিনমান পড়ে থাকতাম ক্রিকেটের ব্যাট-বল নিয়ে। স্কুলশিক্ষক মা হাসিনা আক্তার মাঝেমধ্যে বকাঝকা করলেও আমার ইচ্ছাকেই গুরুত্ব দিতেন। ব্যাংকার বাবা রফিকুল ইসলাম আর বড় ভাই দারুল রৌশনও দিতেন অকুণ্ঠ সমর্থন। সত্যি বলতে কী, অনেক আনন্দে কেটেছে আমার শৈশব। আসলে আমার আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের কাছ থেকে সব সময় নিজের ইতিবাচক চিন্তার স্বাধীনতা পেয়েছি। মূলত, মায়ের অনুপ্রেরণাতেই আমি আজকের এই অবস্থানে এসে দাঁড়াতে পেরেছি। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা লালমনিরহাটের পাটগ্রামে। তাহেরা বিদ্যাপীঠে শিক্ষার হাতেখড়ি। হুজুর উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হই বিকেএসপিতে। বিকেএসপি থেকে এসএসসি দিয়ে ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হই আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনে স্নাতক ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে স্নাতকোত্তর করি।
লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছি। মাঠই আমার বড্ড আপন। সব সময় চাইতাম, মাঠের মাঝখানে থাকতে। পৃথিবীর সবচেয়ে দাপুটে ক্রিকেটারকেও অবসরে যেতে হয়। আমাকেও সেই পথ মাড়াতে হয়েছে। তবে মাঝ মাঠকে আপন করতে অনেক আগেই আম্পায়ারিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি। গত বছর হংকংয়ে অনুষ্ঠিত এমার্জিং এশিয়া কাপে খেলতে যাই। সেখানেই মূলত খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলি। সেই দিন খেলা শেষ করেই বিমানে বসেছি আম্পায়ারিংয়ের উদ্দেশ্যে। চেয়েছিলাম, যেদিন আমার আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিংয়ের সুযোগটা ফাইনাল হবে, সেদিনই খেলা ছাড়ব; তা-ই হয়েছে। এ ছাড়া খেলার মধ্যে ধারাভাষ্য দিয়েছি। করেছি টিভি অনুষ্ঠান। ধারাভাষ্য দিলে অনেক কিছুই শেখা যায়। তখন আমাদের অত টুর্নামেন্ট হতো না। বছরে এক বা দুটি টুর্নামেন্ট হতো। বাকি সময়টা বসেই কাটাতে হতো। ফ্রি সময়টা ক্রিকেটের সঙ্গে থেকেছি।
২০২৩ সালের ১০ জুলাই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলি। মাঠ থেকেই সতীর্থরা আমাকে বিদায় দিয়েছেন। জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন এটি। খেলা ছিল বিকেএসপির মাঠে। পাশের আরেকটি মাঠে আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচ ছিল। সেই মাঠ থেকে সালমা-রোমানাসহ সবাই দৌড়ে এসেছিল। চারটি দল। সবাই ব্যাট নিয়ে মাঠের দু’পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছে। ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছে। ফুল ছিটিয়েছে– এসব দেখে আমার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়েছে। এরচেয়ে আনন্দের আর মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি থাকতে পারে না একজন খেলোয়াড়ের জীবনে। আমি সেদিন খুব ভালো পারফর্মও করেছি। সেদিনের কথা ভুলতে পারব না!
আম্পায়ারিংয়ে অর্জন বলতে এটিই তো আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া যে, দেশের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক নারী আম্পায়ার আমি। আমাদের সামাজিক যে প্রতিবন্ধকতা, সেই প্রতিবন্ধকতাকে ছাপিয়ে আম্পায়ারিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছি, এটিও কম কী! বর্তমানে জাতীয় দলে খেলছে এমন চার-পাঁচজন মেয়েকে আমি একেবারে জিরো থেকে তুলে এনেছি; যারা ঢাকার বাইরের এবং যাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ওদের অনেককে আমার বাসায় রেখে প্র্যাকটিস করিয়েছি। শিশুপল্লি প্লাস নামে একটি অরফান হাউসে ছোটদের কোচিং করিয়েছি। সেখানকার অনেক মেয়ে এখন স্বাবলম্বী হয়েছে। প্রিমিয়ার লিগে খেলছে। আনসারে চাকরি করছে খেলোয়াড় হিসেবে। অনেকে বিকেএসপিতে আছে। পাটগ্রামে ক্রিকেট একাডেমি গড়ে তুলেছি। প্র্যাকটিসের জন্য তাদের এখন আর রংপুর বা ঢাকামুখী হতে হয় না। বাড়িতে থেকেই ক্রিকেটের পাঠ নিচ্ছে। সেই সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারছে। যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তারা পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে অনুশীলন করছে। 
সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়ে গেছে আমাকে নিয়ে অনেকটা আমার সম্পর্কে অজানা তথ্যে ভর করে। আমি মূলত আমার কাজটা করেছি। আমার প্রথম ম্যাচ, ক্যারিয়ার– এসব নিয়েই বেশি মনোযোগী ছিলাম। তবে যা হয়েছে তা হয়তো ভালোর জন্যই হয়েছে! এর মাধ্যমে এটিও বুঝতে পেরেছি, আমরা নারী আম্পায়ারদের কীভাবে দেখি। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি। বেশির ভাগ মানুষ এবং সিংহভাগ গণমাধ্যম ইতিবাচক খবর প্রকাশ করেছে। এটি অনেক ভালো লাগার বিষয়। তবে ঝড় যা গেছে, তা আমার ওপর দিয়েই গেছে; যা শোনার আমিই শুনেছি। সামনের দিনে যেসব নারী আম্পায়ার আসবেন, তারা এমন ঝড়ের মুখোমুখি হবেন না নিশ্চয়ই! 
অনেক বড় স্বপ্ন আমার। বিশ্বের সেরা আম্পায়ারদের একজন হিসেবে অবসরে যাওয়া। আগামী দিনে অসংখ্য নারী আম্পায়ার দেখবেন আপনারা। তারা নিশ্চয়ই আমার দেখানো পথেই হাঁটবেন। আর আমি অবসরে গেলে হয়তো তাদের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে বেড়াব। এরচেয়ে বড় অর্জন এবং বড় স্বপ্ন আর কীইবা হতে পারে! 

আন্তর্জাতিক
নারী আম্পায়ার

আরও পড়ুন

×