আগামীর আশাবাদী বাংলাদেশ

ইলোরা গহর
ইলোরা গহর
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৬
‘জুলাই ট্র্যাজেডি’ জাতির ইতিহাসে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য দৃষ্টান্তমূলক এক আন্দোলন-সংগ্রামের নাম। একাত্তরে অন্যায় হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে বীর বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল। ২০২৪ সালেও অন্যায় হয়েছে; এবার আমাদের ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়িয়েছে। এ বিজয় এমনি এমনি আসেনি। ৩৫ দিনের আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে নিহত হয়েছেন শত শত বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন অনেকে। কেউ কেউ এখনও হাসপাতালে বসে কাতরাচ্ছেন।
২৪-এর আন্দোলনে আমি সরাসরি অংশ নিয়েছি। আন্দোলনে গিয়ে নিজের প্রচারের আশায় কোনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াইনি। দেশকে ভালোবেসে আন্দোলনে শামিল হয়েছি। সেই ২০১৮ থেকেই রাস্তায় নেমেছি। বিজয় এসেছে চব্বিশে। লাইভে বহুবার আহবান জানিয়েছি আন্দোলনের। দেশকে ভালোবাসি বলেই আমার প্রতিটি লাইভে নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ মুজতবা আলী, আহমদ ছফাসহ অনেক জ্ঞানী মানুষদের নাম স্মরণ করেছি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যখন আন্দোলনে উত্তাল ছিল, তখন আমি আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছিলাম। সেখানে অনেক দুঃসময় কাটিয়েছি। আমি এক কাপড়ে চার-পাঁচ দিন থেকেছি। রাস্তায় রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজেছি। একটা কথা এখন খুব মনে পড়ে। আন্দোলন করতে করতে আমার বুকের মধ্যে দুই শিক্ষার্থী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমার নিজের বোতলে যা পানি ছিল তা না খেয়ে দুই অজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে ও মাথায় দিলেছিলাম। এখানে আমি ৭১ দেখেনি, জুলাই দেখিনি। এই সন্তানগুলোর মধ্যে আমার বাবার চেহারা দেখেছি। আবার বাবা প্রয়াত নয়ীম গহরের ডায়েরিতে লেখা ছিল ‘কবে আমরা নিঃশ্বাস নেবো’। এটি ১৯৬০ সালের কথা। গত ১৬ বছরও বাবার কথাটাই যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা নয়ীম গহর দেশের জন্য ১৯৫০ সাল থেকে লড়ে আসছিলেন। আমরা তো একসময় জানতাম তিনি মারা গেছেন। পরে তাঁকে আমরা ফিরে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমার মা রিজিয়া গহরও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সন্তানদের নিয়ে করেছেন নানামুখী সংগ্রাম। শেখ হাসিনার চেয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও দোসররা সবচেয়ে বেশি অন্যায় করে ফেলেছেন। এই যে দেশটার এত অধঃপতন হলো, এর পেছনে শিল্পী সমাজের ভূমিকা রয়েছে। শিল্পী এবং নির্মাতাদের অপরাজনীতি ও চাটুকারিতা দেখে লজ্জায় মুখ লুকাতে হতো। গুটিকয়েক শিল্পী সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছিল। শিল্পীসত্তা ভুলে গিয়ে তারা দলীয় কর্মীতে পরিণত হয়েছিল। যে কারণে তাদের এখন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে। সব জায়গায় দলীয় লেবাসওয়ালা কিছু মুখই ঘুরেফিরে দেখা যেত। গত ১৫ বছরে নানা অনিয়ম দেখেছি। কিছু শিল্পী ফায়দা লুটেছে। তাদের কারণে আমরা কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। বেতার, টিভিতে আমরা কাজ পাইনি। একই শিল্পীকেই বারবার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে হঠাৎ দু’একজন যোগ্য শিল্পীকেও দেওয়া হলেও, সেটা হাতেগোনা। তাড়াহুড়া করে সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয়েছে জাতীয় পুরস্কারের জন্য। অরাজক এক পরিস্থিতি ছিল। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আমাদের গর্ব। দেশকে উন্নত করাই তাঁর লক্ষ্য। সেগুলো তিনি নিজস্বভাবে বাস্তবায়ন করতে চান। তাঁর লক্ষ্যের দিকেই এগিয়ে চলছেন তিনি। দেশকে আন্তর্জাতিক লেভেলে আনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এই গুণী মানুষটি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি পেরেছেনও।
জুলাই বিপ্লব আমাদের বড় অর্জন। শেখ হাসিনার সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে, এর বিচার আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে চাই। এই বিপ্লবে যারা আহত হয়েছেন, মনে হয় আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের প্রতি অবহেলা করছি। আমার মনে হয় প্রধান উপদেষ্টার এ বিষয়ে আরও গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। আহতদের অনেকেই এখনও পর্যন্ত কোনো সাহায্য পায়নি। দেশের জন্য যাদের এত আত্মত্যাগ তাদের প্রতি আমাদের আরও যত্নবান হওয়া উচিত। জুলাই বিপ্লবে শহীদদের স্মৃতি চিরজাগরূক রাখাটাও জরুরি বলে মনে করি। শহীদের নামে স্টেডিয়ামসহ নানা স্থাপনার নামকরণ করা উচিত। এখন অনেক সমন্বয়কারীর নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে। কথায় কথায় আন্দোলন চলছে। বিএনপির নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। তবে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে তারেক রহমানের কঠোর হুঁশিয়ারির কারণে তা কিছুটা বন্ধ হয়েছে। তবে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। জনতার সঙ্গে সরকারের ব্যবধান কমিয়ে আনা দরকার। এ লক্ষ্যেই সরকারের কাজ করা উচিত। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। জনগণ তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ভোট প্রদান করে আসছিল। আওয়ামী শাসন আমলে ভোটের কথা মানুষ ভুলতে বসেছিল। আবার মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে তারা ভোট দেবে। সাধারণ মানুষ খেতে পারুক আর না পারুক, তারা ভোট দিতে উদগ্রীব হয়ে আছে।
তরুণদের উদ্দেশে একটা কথা বলব, পড়াশোনাটা সবার আগে ঠিক রাখতে হবে। পড়াশোনা করে নিজের জগৎকে পাল্টে দেওয়া যায়। দেশকে যদি সবাই ভালোবাসে, তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে। এ দেশটা আমাদের। আত্মকেন্দ্রিকতা বাদ দিতে হবে। তাহলে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পরও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অনেক বাধা এসেছে। মাঝপথে নাটক বন্ধ হয়েছে। মানুষ মঞ্চ নাটক দেখতে চায়। এটি আজকের নয়, অনেক আগ থেকেই। বরেণ্য অভিনয়শিল্পী মামুনুর রশীদকে অভিনয়ে বাধা দেওয়া হয়েছে। এটি মোটেও কাম্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে তো সংস্কৃতির পথ রুদ্ধ হবে।
ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি বহু বছর। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। দর্শক এখন সবকিছু দেখে, খোঁজ রাখে; তাই আমাদেরও অনেক সচেতন হয়ে কাজ করতে হয়। নতুন নতুন অনেকে ছোট-বড় সব পর্দায় কাজ করছে, ভালো ভালো সিনেমা হচ্ছে, দর্শকও আবার হলে গিয়ে সিনেমা দেখছে। বাংলাদেশকে আমি আরও গোছালো দেখতে চাই; এখনও মনে হয় অনেক জায়গাতেই আমরা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারিনি। তবে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। আমরা সব দিক থেকেই নিজেদের মতো করে চেষ্টা করছি, এগিয়েও যাচ্ছি। শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে উঠছে। এগুলো এখন ছোট ছোট সাফল্য মনে হলেও একটা সময় বড় একটা পরিবর্তনের ধারা হয়ে উঠবে। এই মুহূর্তে দেশের একটা বিশালসংখ্যক মানুষ তারুণ্য পার করছে এবং সেটার প্রভাব প্রতিটি সেক্টরে খেয়াল করলেই বোঝা যায়। তরুণরা এখন বেশ সচেতন। নিজের স্বপ্ন, ভিশন নিয়ে তাদের চিন্তা বেশ ক্লিয়ার আর বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যও ধীরে ধীরে একটা জেনারেশন তৈরি হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ যখন হয়েছে, তখন যেটা ডিমান্ড করেছে তরুণরা সেটা করেছে, এখনকার সময় যেটা ডিমান্ড করছে তরুণরা সেটাই করবে, করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আর চাহিদা বদলায় প্রতিটি দেশের, মানুষের, সবার।
অনেক নতুন ছেলেমেয়ে এখন ইন্ডাস্ট্রি লিড করতে আসছে। সবাই কিছু না কিছু বানাচ্ছে, এক্সপেরিমেন্ট করছে। সবকিছু হয়তো এখনও আমরা দেখে উঠতে পারছি না; তবে কেউ এখন আর ঘরে বসে নেই। যত বেশি তারুণ্য আসবে ইন্ডাস্ট্রিতে, তত জায়গাটার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে, নতুন ধারা শুরু হবে। নিজের জায়গা থেকে আমি ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়েই বেশি স্বপ্ন দেখি। এখনও অনেক কিছু আমাদের অগোছালোভাবে করে যেতে হয়, এখান থেকে গুছিয়ে উঠে আরও সহজভাবে সব কাজ করতে পারার স্বপ্নই দেখি।
অভিনয়শিল্পী
- বিষয় :
- বাংলাদেশ