তারুণ্যের হাত ধরে সময় এগিয়ে যায়

লেলিন চৌধুরী
লেলিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৭
একেবারে ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে শুরু। সেটি হলো সরকারি চাকরিতে ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন। প্রথমবার আন্দোলনটি শেষ হয়েছিল একটি অযৌক্তিক বিরাগজাত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধার বংশধরদের জন্য কোটা থাকবে না তাই কারও জন্যই কোটা রাখার দরকার নেই। বেশ পরে উচ্চতর আদালতে গিয়ে খুঁচিয়ে বিষয়টিকে আবার সামনে আনা হয়। ছাত্ররা আবার আন্দোলনে নামে। তৎকালীন সরকার অবহেলা, উস্কানি এবং বেআইনি পেশি ও অস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক বর্বর হত্যাকাণ্ড শুরু করে। শিশু কিশোর তরুণ ছাত্র শ্রমজীবী মানুষকে নির্বিচারে খুন করা হতে থাকে। মনে হচ্ছিল দেশের সরকার দেশবাসীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ এবং গণহত্যা শুরু করে দিয়েছে। অবধারিতভাবে ছাত্রদের আন্দোলন জনসাধারণের সম্মিলনে স্বৈরাচার পতনের একদফা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। তিন সপ্তাহের ঘূর্ণিঝড়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। এ ঘটনাটি দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতা ও তাত্ত্বিকদের মহাবিপদে ফেলে দিয়েছে। অভ্যুত্থানের নায়কগণ তাদের শলাপরামর্শ গ্রহণ করেনি। খ্যাতিমানগণ নিজেরা পুরো বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই শক্তিমান স্বৈরাচারের প্রতিভূ পগার পার। ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ অভ্যুত্থানকে মেনে নিতে তাদের একদিকে কষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে তারা নিজ অসামর্থ্যের কারণে নিজেদের ওপর বিরক্ত বোধ করছে। ‘কেন এই সহজ সাধারণ বিষয়টি আমরা বুঝতে পারলাম না?’– এ প্রশ্নটি তাদের দংশিত করছে। এ দেশের লেখাপড়া জানেওয়ালা বুদ্ধিজীবী, লেখক, অধ্যাপক, রাজনৈতিক নেতা প্রমুখের কাছে এখনকার তরুণরা হচ্ছে ফেসবুক জেনারেশন, টিকটক জেনারেশন, ব্রয়লার মুরগি জেনারেশন ইত্যাদি। এই প্রজন্মের জানাশোনার মান, দেশপ্রেম ইত্যাদি নিয়ে পূর্ব প্রজন্মের ধারণা অতি নিচু। তারা প্রায়ই বলে থাকেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েদের দিয়ে কিচ্ছুটি হবে না’। সেই ফেসবুক/ টিকটক/ব্রয়লার মুরগি প্রজন্ম ‘পরম পাকা’ অভিজ্ঞদের থোড়াই কেয়ার করে দেশের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের তুর্কি হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। প্রবল পরাক্রান্ত শাসকের প্রাসাদ জনতার উল্লাস মঞ্চে পরিণত হয়েছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এই পরিবর্তনকে ধারণ করে দেশ কি সামনের দিকে অগ্রসর হবে, হতে পারবে? এটা আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় এবং কঠিন প্রশ্ন। ১৯৭১-এর বিজয় বেহাত হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জয়। তাই আশাবাদী মানুষের মনের কোণে ভয় ও দ্বিধার মেঘ এখনও জমে আছে।
প্রতিটি দেশে মানুষের চিন্তাভাবনা, বুদ্ধিমনস্কতা ও সচেতনতার অনেক স্রোত যুগপৎভাবে বহমান থাকে। এখানে যেমন অতি-অগ্রসর ও অগ্রসর ভাবনা থাকে, তেমনই পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনাও থাকে। চিন্তাস্রোতগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি গড় ভাবনা বা কনসেপ্ট তৈরি হয়। এ গড় ভাবনার স্রোতধারাটিই মূলত সমাজের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। সহজ কথায় এটিকে দেশের গণআকাঙ্ক্ষার মূলধারা বলা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গণআকাঙ্ক্ষার ধরন ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সমাজের অগ্রবর্তী মানুষদের মধ্যে যে বা যারা দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রত্যাশা আত্মস্থ করে সেটিকে ভাষায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে সমর্থ হয় মূলত তারাই সমাজের, সমাজ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সদ্য সংঘটিত জুলাই অভ্যুত্থানেও এর প্রতিফলন লক্ষণীয়। ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থানের আগে দেশের উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ প্রমুখ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আবেগজাত ধারাটিকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছেন। এমনকি ঐতিহাসিক সত্যকে আবেগের বাইরে এনে তথ্যে রূপান্তরিত করতে পারেননি। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অনেক বিষয় নিয়ে যৌক্তিক বিশ্লেষণ করাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরুদ্ধ’ বলা হতো। এসব ক্ষেত্রে বিশ্লেষণকারী বা প্রশ্ন উত্থাপনকারীকে অতিদ্রুত ‘রাজাকার’ নামফলক লাগিয়ে দেওয়া হতো। এরপর সেইসব ব্যক্তির ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন চলত। বস্তুগত প্রয়োজন এবং তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি আবেগীয় প্রয়োজনের সংমিশ্রণে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমাদের জীবিতকালে চোখের সামনে সংঘটিত ’৭১-এর মহৎ ঐতিহাসিক ঘটনাকে একজন ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারকেন্দ্রিক ভাষ্যে রূপান্তরিত করা হচ্ছিল। এ জাতীয় বিষয়গুলোকে এ দেশের সাধারণ মানুষ অন্তর থেকে গ্রহণ করে নাই।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করে। এ ঘোষণাপত্রে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গণতান্ত্রিক বিধিবিধান ও রীতিনীতি ভঙ্গ করা, জনসাধারণের ওপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা ও নৃশংস অত্যাচার করার কারণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এ দেশটি প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে’। মনে রাখতে হবে এ ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি নয়, বাংলাদেশ নামক দেশটির প্রতিষ্ঠা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা এবং নেতৃবর্গ দেশের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতাগণের মর্যাদা অবশ্যই পাবেন। কিন্তু জাতির জনক বা পিতা অভিধাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে কোনোক্রমেই যুক্ত নয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র পথ হারাতে শুরু করে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে বিসর্জন দিয়ে নানা ধরনের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে।
স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষতবিক্ষত করা হতে থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চৌদ্দ দলীয় জোট শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকারের হাতে বাংলাদেশের দুর্বল নির্বাচনী ব্যবস্থা নিহত এবং কবরস্থ হয়। ফলে এই সময়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ শিকড় গেড়ে বসে। রাজনৈতিক স্বৈরাচারের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের মানুষের অর্থ আক্ষরিক অর্থেই হরিলুট হতে থাকে। লুটকৃত অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি ও পরিবারের প্রশংসাকীর্তন দ্বারা জনসাধারণকে সম্মোহিত করে রাখতে চায়। মুক্তবুদ্ধি, জ্ঞান ও যুক্তির চর্চাকে রুদ্ধ করা হয়। প্রতিটি বিষয়কে প্রশ্ন করে সত্য নিরূপণের বিজ্ঞানসম্মত পন্থার বিস্তার এবং বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে অন্ধ আবেগকে পরিহার করে যুক্তিগ্রাহ্য আবেগভিত্তিক বিশ্লেষণের পথকে ফ্যাসিবাদ বন্ধ করে দেয়। এরা দলকানা, দলদাস, মস্তিষ্কবন্ধক রাখা বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, লেখক তৈরি করে একটি ‘জ্বি হুজুর’ পারিষদ গঠন করে। ফলে সৃজনশীলতার পথ সংকীর্ণ হতে থাকে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একটি হীরক রাজ্য তৈরির পথ প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হতে থাকে।
বাংলা ভাষায় রচিত একটি বিখ্যাত নাটকের নাম নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নাটকটির রচয়িতা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নামে সিনেমাও হয়েছে। সেই নাটকের একটি সংলাপ– ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা, জাতির সৌভাগ্য-সূর্য আজ অস্তাচলগামী; শুধু সুপ্ত সন্তান-শিয়রে রোরুদ্যমান জননী নিশাবসানের প্রতীক্ষায় প্রহর গণনারত। কে তাঁকে আশা দেবে? কে তাঁকে ভরসা দেবে? কে শোনাবে জীবন দিয়েও রোধ করব মরণের অভিযান?’ বাংলাদেশের অন্তরাত্মা থেকে উৎসারিত এরকম আক্ষেপ বাণী সারাদেশকে করুণ চাদরে ঢেকে দিচ্ছিল তখন। প্রতিবাদহীন শক্তের পদতলে মানুষ, মানবিকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন দলিত হচ্ছিল। সেই সর্বনাশা দুঃসময়ে ‘অরুণপ্রাতের তরুণদল’ এগিয়ে এলো। তাদের মুখে মাভৈঃ মন্ত্র, চোখে নতুন দিনের স্বপ্ন। তারুণ্য তার সাহস-সুন্দর উদ্ধত আত্মবিশ্বাসী চোখে স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুতে চোখ রেখে কথা বলার স্পর্ধা রাখে। সে আঙুল নির্দেশ করে প্রশ্ন করতে পারে ‘রাজা তোর পোশাক কোথায়?’ তারুণ্যের এই প্রশ্নে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ধ্বনিত হয়। তখন বিজ্ঞ পণ্ডিত বুদ্ধিজীবী নয়, একেবারে প্রদীপ্ত তরুণের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে জনতা তাদের সঙ্গে জোট বাঁধে। এই জোট গণআকাঙ্ক্ষার বিপরীত শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ এক বিস্ময়কর শৌর্য এবং আত্মদানের প্রতিযোগিতা। গুলিভরা আগ্নেয়াস্ত্রের বিপরীতে নগ্নবুকের তুলনাহীন প্রতিরোধ। ছুড়ে দেওয়া গ্রেনেডের বিপক্ষে আট বছর বয়েসী শিশুর মুষ্টিবদ্ধ হাত। প্রতিটি মৃত্যু যেন অজস্র প্রতিরোধযোদ্ধার জন্ম দিতে থাকে। অনিবার্যভাবে এ লড়াইয়ে তরুণ ও জনতার জোট জয়ী হয়। এভাবেই অচলায়তন ভেঙে দেশ ও সময় সামনে এগিয়ে যায় তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১-এর গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে তারুণ্যের শক্তিতে। জীবনকে হাতের মুঠোয় ধরে মানুষের জন্য, দেশের জন্য ভয়হীন দৃঢ়তায় লড়তে জানে তারুণ্য। সে তার বুকের সবটুকু রক্ত ঢেলে দেবার সামর্থ্য রাখে। ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নেই তার ক্ষয় নেই’। তারুণ্যের শক্তি চির অক্ষয়।
স্বাস্থ্য, পরিবেশ
ও শিশু অধিকারকর্মী
- বিষয় :
- তারুণ্যের প্রতিবাদ