ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

আত্মোপলব্ধি

চিন্তাধারার পরিবর্তন আনুক সহাবস্থান আর সম্প্রীতি

চিন্তাধারার পরিবর্তন আনুক সহাবস্থান আর সম্প্রীতি

ছবি: ফজলুল হক পাভেল

ফজলুল হক পাভেল

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৯:২৪ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৯:২৬

সময়টা ২০১৬ সালের শুরুর দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর্ব চলে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে বিভাগীয় শিক্ষাভ্রমণে বান্দরবানের উদ্দেশে বের হই। চলতি পথের নানা ঘটনা এখনও স্পষ্ট মনে পড়লেও একটি ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে ভাবায়। চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে বিবেককে। দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত কিংবা মানসিকতাই কি আমাদের মানবিক ও মৌলিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী এমন প্রশ্নের বৃত্তে ঘোরপাক খেতে থাকি।

রাতের ট্রেন যাত্রা শেষে সকালে গিয়ে পৌঁছালাম বান্দরবান শহরে। সেখান থেকে নাস্তা করে চান্দের গাড়ি করে সোজা থানচি বাজার। থানচিতে সাঙ্গু নদীতে করেই রেমাক্রী যেতে যেতে বিকেল চারটা পেরোলো। তখনও পুলিশি তথ্য হালনাগাদ শেষ হয়নি বলে রওনা দিতে পারিনি আমরা। আমরা নয় দশজনের মতো বন্ধু নদীর ঘাটে অপেক্ষা করছি। বাকিরা বিজিবি ক্যাম্পে বসে। আশপাশে নৌকার মাঝিরা কেউ বা পানি সেচে যাচ্ছেন নৌকার, কেউবা বসে আছেন। প্রথমবার যাওয়ার ফলে হা করে সবাই দেখছি চারপাশের সৌন্দর্য।

এতোকিছুর মাঝে একটি বিষয় দেখে ভীষণ বিস্মিত হলাম, আবার মনে হলো- বড় একটা ধাক্কা লাগলো বিবেকে। কী নিয়ে সেটা নিয়েই আজকের ভাবনা। সেখানে মুসলমান আর আদিবাসী ছাড়া অন্য কোনও গোত্র বাস করে না সম্ভবত। করলেও সেটা সংখ্যায় কতো তা জানতে গুগলের সাহায্য নিতে হবে হয়ত।

বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম আমরা। এর মাঝে কেউ নতুন নৌকা প্রস্তুতে ব্যস্ত, কেউ পানি সেচে যাচ্ছে নৌকার। পর্যটকের দল এদিকে অপেক্ষায় নৌকায় চড়তে। কেউ কেউ দল বেঁধে এসেছে গোসলে। গ্রামের পুকুরগুলোতে নারী পুরুষের সমবেত গোসলের কথা শুনে থাকলেও এখানকার দৃশ্যে বাস্তবতা প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করলাম।

সদ্য গোসল শেষ করা কিশোর কিশোরীরা ওঠে আসছে সাঙ্গুর তীরে। তার পাশের ব্রিজ দিয়ে চলে যাচ্ছে চান্দের গাড়ি। অদূরেই পাহাড় আর উঁচু নিচু রাস্তা। সমতলের মানুষ বলে এমন দৃশ্য আগে দেখা হয়ে ওঠেনি।

বাঙালি কিশোর-কিশোরী কিংবা আদিবাসী দুইই দেখা গেছে এখানে। মারমা, চাকমা, মুরং, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বোম, খেয়াং, চাক, পাংখো ও তংচংগ্যাসহ নানা আদিবাসীর বাস এখানে। সবাই মিলে যেন এক ঘর এক পরিবার। এমনটাই হয়ত ভাবেন তারা। সেজন্য তাদের মাঝে আন্তরিকতার ঘাটতি কখনই দেখা যায় না। দেখা যায় না দ্বন্দ্ব। মনে হয় একই ঘরে বেড়ে ওঠা অভিন্ন আত্মায় নানা সংস্কৃতির।

গোসল সেরে স্বাভাবিকভাবেই তারা জামা পরিবর্তন করছিলেন ন্যূনতম প্রাইভেসি মেনে। তবে তাতে জড়তা দেখা যায়নি। ওই যে বললাম না একই ঘরে বেড়ে ওঠা অভিন্ন আত্মায় আত্মীয় তারা। পার্থক্য শুধু সংস্কৃতির। যে পার্থক্য আলাদা করে না তাদের। মনে উঁকি দেয় না বাজে ভাবনা। নেতিবাচকতার স্বর্গরাজ্যে বাস করা আমাদের শহুরে মানুষগুলোর মাঝে এমন হয়ত কখনই লক্ষ্যনীয় হবে না। তবে সেখানে তেমনটি দেখিনি আমি।

আমাদের ছেলেদের বেলায় প্রাইভেসি যতোটা না গুরুত্বপূর্ণ মনে করি মেয়েদের বেলায় তার অন্ত নেই। অথচ সেখানে আগত পর্য‌টকদের সামনেও আদিবাসী ওই কিশোরীদের বিব্রত হতে দেখিনি। তাদের সংস্কৃতি, তাদের অভিন্ন মানসিকতা তাদের এক করে রেখেছে। তাদের কাছে নিরাপত্তাজনিত ইস্যু হয়ে ওঠেনি এই সমতল আর পাহাড়ের মানুষের সম্পৃক্ততা। নিজেদের মতো করে সাজানো জগতে তারা যেন নিজেদের সবচেয়ে সুন্দর সময়টুকু পার করছে। তাতে ক্ষতির কারণ হচ্ছে না কোনও আগন্তুকের চোখ। এ ব্যাপারে সেখানকার জেলে কিংবা নৌকার মাঝি, আদিবাসী নারী কিংবা পুরুষ, কিশোর-কিশোরী কিংবা পর্যটক কারোরই মাথাব্যথা নেই।

তবে সমতল থেকে আসা বহিরাগত কজন আড়চোখে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছিল। হয়ত এমন সহাবস্থান আর সম্প্রীতি কোথাও দেখা হয়ে ওঠেনি তাদের। পরে বিষয়টি স্বাভাবিক বিবেচনায় নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেন তারা।

আমি শহর কিংবা সমতলের গ্রামের প্রেক্ষাপট চিন্তা করে দেখলাম, পাহাড়ের খুব স্বাভাবিক এ ঘটনা আমাদের সমতলে বর্তমানে তো কল্পনাই করা যায় না। এমন কিছু আমাদের মাঝে নেতিবাচকতা সৃষ্টি করতো, কাউকে হয়ত বিপ্লবী হয়ে ওঠতে দেখতাম। কেউ হয়ত চোখের লজ্জায় এড়িয়ে যেতেন। কেউবা প্রতিবাদী কণ্ঠে বলতেন, এসব নোংরামি চলবে না বাংলায়। কেউ হয়ত হামলে পড়তেন দলবল নিয়ে।

কিন্তু এসবের কিছুই সেখানে হতে দেখা যায় না কখনই। সেসব নেতিবাচকতা তাদের কখনই স্পর্শ করে না। এমনটি উচিতও নয় বলে মনে করি।

অন্যদিকে সমতলের পরিবার, সমাজ তার বাসিন্দাদের শুদ্ধ মানবিকতায় সেভাবে আনতে পারেনি, মুখোশ পরিয়ে রেখেছে। তাই হয়ত এখানে নারী নিগ্রহ, নির্যাতন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় হরহামেশা।

পুরুষতান্ত্রিক রীতিনীতি আমাদের অযুহাত দেখিয়েছে, মানুষ করেনি। গড়ে সারা দেশে যে পরিমাণ নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের শিকার হন তার বাৎসরিক হিসাব টানলেও পার্বত্য অঞ্চলের কয়েকযুগে এজাতীয় ঘটনা চারভাগের একভাগও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সে উত্তর কখনও কি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি আমরা? হয়ত সদিচ্ছা আসেনি মনে। হয়তবা এড়িয়ে গেছি নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে। তবে ভাবনার জায়গায় এটুকুন স্পষ্ট হয়ে আসে যে, আদিবাসী সেসব মানুষের মাঝে একে অপরের প্রতি যে সম্মান আছে, শ্রদ্ধা আছে, মানুষ ভাবতে শিখেছে তারা একে অপরকে তা আমাদের মাঝে আসলে লালিত হয়েছে খুব কম।

তবে এটিও সত্য নয় যে আমরা নিজেদের শুদ্ধতার মাঝে রাখি না, চর্চা করি না, তলিয়ে ভাবি না। আমরা ভাবতে চাই, ভাবতে শিখি। তাইতো কোথাও কোনো নারীর সঙ্গে অন্যায় হলে আমরা প্রতিবাদ করি, প্রতিবাদী হই পাহাড়ে আদিবাসীদের নিরাপত্তায় কেউ আঘাত হানলে। আমাদের এই মানুষ হয়ে ওঠার সংগ্রামে পূর্ণাঙ্গতা আসবে তখনই যখন নিজেদের মানুষ বলে ভাবতে শিখবো, মানসিকতা, চিন্তাধারার পরিবর্তন করবো।

পাহাড়ের ওই শান্ত স্নিগ্ধ ধুন আর বয়ে চলা নদীর কলতান যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে সে জনপদের মানুষের জীবন, করেছে অভিন্ন ও এক পরিবারের করে, সেই মানসিকতার চর্চা হোক আস্তেধীরে। পরিবর্তন আসুক একটু। এই পরিবর্তন নিশ্চয়ই চাই আমরা। এই পরিবর্তনই আমাদের নিশ্চয়তা দেবে অনিন্দ্য সুন্দরের মাঝে বাঁচতে।

ফজলুল হক পাভেল: সহ-সম্পাদক, দৈনিক সমকাল ও চিত্রশিল্পী

আরও পড়ুন

×