টেরারিয়াম: কাচের জারে ছোট্ট বন

কাঁচের জারে সুদৃশ্য টেরারিয়াম। ছবি: সংগৃহীত
মো. মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:১৫ | আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৭:০৩
শহুরে জীবনে সবুজের সমারোহ তেমন দেখা যায় না। ইট, কাঠ আর পাথরের ছড়াছড়ি। জঙ্গল কিংবা পাহাড়ের বিশালতায় হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইচ্ছা হলেই মন ভরে নেওয়া যায় না বুনো গন্ধ। নাগরিক জীবনের এমন বাস্তবতায় ঘর বা অফিসের টেবিলে যদি গড়ে তোলা যেত একটি ছোট বাগান, যেখানে থাকত বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও কীট-পতঙ্গের সমারোহ; সময়ের সঙ্গে গাছগুলো বেড়ে উঠত; তৈরি হতো স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ইকোসিস্টেম!
শুনতে কিছুটা অবাস্তব হলেও এর সবকিছুই সম্ভব টেরারিয়ামে। খুব কম জায়গায় সবুজের নতুন জগৎ টেরারিয়াম।
টেরারিয়াম কী
টেরারিয়াম ইংরেজি শব্দ। লাতিন শব্দ ভিভারিয়াম থেকে টেরারিয়ামের উৎপত্তি। ভিভারিয়াম অর্থ বদ্ধপরিসরে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলা, পার্ক বা সংরক্ষণ করা। টেরা অর্থ শুষ্ক ভূমি, ভূপৃষ্ঠ বা স্থলভাগ। টেরারিয়ামের অর্থ হলো, বদ্ধ স্থলভাগে বাস্তুতন্ত্র। তবে টেরারিয়াম শব্দটির আরও একটি সুন্দর অর্থ আছে। টেরারিয়াম মানে ‘প্লেস অব লাইফ’ বা জীবনের জন্য জায়গা। অন্য অর্থে ‘টেরারিয়াম’ হলো অন্দরে ছোট বাগান, যা ঘরের ভেতরেই ডেকে আনে প্রকৃতির মুগ্ধতা।
টেরারিয়াম দেখতে অনেকটাই অ্যাকুয়ারিয়ামের মতো। অ্যাকুয়ারিয়াম জলজ আর টেরারিয়াম স্থল পরিবেশের প্রতিলিপি তৈরি করে। ছোট আকারের গাছপালা, শৈবাল, ফার্ন, নানা বর্ণের পাথর, ছোট আকৃতির ডালপালা, আবার অনেক সময় ছোট ছোট জীবজন্তু ও পোকামাকড় দিয়ে সাজানো হয় এই টেরারিয়াম। এটি তৈরিতে সাধারণত কাচের পাত্র ব্যবহার করা হয়।
টেরারিয়াম তৈরিতে কতদিন লাগে
গাছগাছালি, পাহাড়-পর্বতের ক্ষুদ্র সংস্করণ বা মিনিয়েচার যা-ই বলুন না কেন, এটি তৈরি করা কিন্তু মোটেও দু-এক দিনের বিষয় নয়। একেকটি টেরারিয়াম তৈরিতে কখনও কখনও দু-তিন সপ্তাহ কিংবা মাসও পার হয়ে যায়। এ সময়ের পরই যে টেরারিয়াম বিক্রির যোগ্য হয়ে যাবে, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। শুধু জারের ভেতর নিখুঁতভাবে গাছপালা বা পাহাড় বসাতেই এতটা সময়ের প্রয়োজন হয়। ভেতরে লাগানো গাছগুলো বড় হতেও তো দিতে হবে সময়।
রাজধানী উত্তরার বাউনিয়ার ঢাকা টেরারিয়ামের কর্ণধার মনিরুজ্জামানের মতে, টেরারিয়াম বানাতে এক মাসের মতো সময় লেগে গেলেও, তা বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে প্রয়োজন হয় প্রায় তিন মাস। জারের ভেতর লাগানো গাছগুলো ঠিকভাবে বেড়ে উঠছে কিনা, এটি নিশ্চিত না হয়ে বিক্রি করা যায় না।
টেরারিয়াম কত ধরনের হয়
টেরারিয়াম দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি খোলা, অন্যটি বন্ধ। বন্ধ টেরারিয়ামের মুখ ঢাকনা বা কর্ক দিয়ে আটকানো থাকে। খোলা টেরারিয়ামে বাতাস ঢোকার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে, ফলে এরা মুক্ত ও তাজা বাতাস পায়।
বন্ধ টেরারিয়াম: ক্লোজড সিস্টেমে ট্রপিক্যাল প্লান্ট ভ্যারাইটিজ অর্থাৎ মস, অর্কিড, ফার্ন, এয়ার প্লান্ট ব্যবহার করা হয়। বন্ধ টেরারিয়ামের পরিবেশ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও আর্দ্র থাকে। এটির মুখ বন্ধ থাকার ফলে ভেতরেই পানিচক্র বিদ্যমান। এটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ টেরারিয়াম বলে। এতে জমে থাকা বাতাস ও কাচ থেকে অতিরিক্ত আর্দ্রতা কমানোর জন্য এটি সপ্তাহে অন্তত একবার খোলা প্রয়োজন। এর ফলে শ্যাওলা বৃদ্ধি রোধ পায়। বন্ধ টেরারিয়ামে আর্দ্রতা কমে গেলে পানি স্প্রে করতে হবে। মাটিতে জীবাণুর আক্রমণ কমাতে বিশেষ মিশ্রণ ব্যবহার করা যায়। যখন বানানো হয়, এর ভেতরেই নিজস্ব ইকোসিস্টেম ক্রিয়েট হওয়ার কারণে এটি ক্লোজড কন্ডিশনেও ভালোভাবে টিকে থাকে।
খোলা টেরারিয়াম: এটি সব ধরনের গাছের জন্য উপযোগী। বিশেষ করে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উদ্ভিদ। এখানের গাছগুলোর জন্য অতিরিক্ত আর্দ্রতার প্রয়োজন পড়ে না। এতে এমন উদ্ভিদ রাখা দরকার, যেগুলোর সরাসরি সূর্যালোক প্রয়োজন হয়। বন্ধ টেরারিয়াম প্রচুর তাপ আটকে রাখতে পারে, কিন্তু খোলা টেরারিয়াম তা পারে না।
কীভাবে তৈরি করবেন
ঘরে সহজেই টেরারিয়াম বানানো যায়। তবে বাজারের টেরারিয়াম বা ফ্লোরারিয়াম নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়। প্রথমে কাচের ফিশবোল, জার, বড় অ্যাকুয়ারিয়াম নিতে হবে। এতে ছোট পাথরের টুকরো, কয়লা, চারকোল, নুড়ি, ঝুরো বালি, মাটি দিতে হবে। প্রথমে দেড় ইঞ্চি পুরু পাথরের স্তরের ওপর কাঠ-কয়লার স্তর, তার পর অন্যান্য উপাদান ও সব শেষে মাটি ব্যবহার করবেন। উদ্ভিদ কী ধরনের, তার ওপর ভিত্তি করে মাটির পুরুত্ব নির্ধারণ করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, মাটিতে যেন বাতাস ভালোভাবে চলাচল করতে পারে। অতিরিক্ত পানি অপসারণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এবার মাটিতে নুড়িপাথর দিয়ে সাজিয়ে পছন্দসই উদ্ভিদ লাগিয়ে ফেলুন।
উদ্ভিদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মস, ফার্ন, ক্যাকটাস অ্যালুমিনিয়াম প্লান্ট, সাকুলেন্ট জাতীয় উদ্ভিদ নির্বাচন করুন। এসব উদ্ভিদের কাণ্ড, শাখা ও মূল পানি সঞ্চয় করে রাখতে পারে।
দরদাম
টেরারিয়ামের দাম নির্ভর করে গাছ বা অন্যান্য উপকরণের ওপর। গাছ ও উপকরণ যত বেশি হবে, স্বাভাবিকভাবেই এর দাম বেশি হবে। টেরারিয়ামের দাম ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩-৪ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
যত্ন
১. সরাসরি কড়া রোদ ও বাতাসে টেরারিয়াম রাখবেন না। শুকনো বা একদম কম আলো পড়ে, এমন জায়গায় রাখা ভালো।
২. বারবার ঢাকনা খুলে দেখবেন না। ভেতরে অটো ইকোসিস্টেম তৈরি হয়, তাই সপ্তাহে একবার পানি স্প্রে করবেন। স্প্রে করার পর কাচের জারে লেগে থাকা পানি পরিষ্কার ন্যাপকিন দিয়ে মুছে নেবেন।
৩. সরাসরি হাতের স্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
৪. গাছ যদি বেশি বড় হতে থাকে, তখন ঢাকনা খুলে সুবিধামতো ছেঁটে নেবেন।
কম খরচে কম পরিচর্যায় গড়ে তোলা এই টেরারিয়াম বা কাচের পাত্রে বাগান আপনার ঘরে আনতে পারে নতুনত্বের ছোঁয়া।
- বিষয় :
- শহর