বাজেট বিশ্লেষণ
করপোরেট করের বোঝা কতটা বইতে পারবে ছোট প্রতিষ্ঠান

.
আনোয়ার ইব্রাহীম
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ | ০০:৫৫
ব্যবসা করলে কর দিতে হবে– এটা সবাই জানে। কিন্তু ব্যবসায় যদি লোকসান হয়? বাংলাদেশে ব্যবসা মানেই কর। লাভ হোক বা লোকসান, সরকার কর আদায় করবে– এই বাস্তবতা নিয়ে দেশে ব্যবসা করতে হয়। ছোট-বড়, নতুন-পুরোনো সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই এই নিয়ম কার্যকর। তবে সাম্প্রতিক বাজেটে প্রস্তাবিত কর কাঠামো বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন বাস্তবতা তৈরি করেছে। ব্যবসার আয় নেই, তবু কর দিতে হবে– এমন এক অযৌক্তিক কাঠামোর মুখোমুখি হচ্ছেন তারা।
অথচ সরকার যেমন বলছে, কর আদায় না হলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিপরীতে ব্যবসায়ীরাও বলছে, ব্যবসা টিকলেই কেবল কর দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ টিকে থাকার শর্তে কর আদায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যবসার শুরুতেই একটি কোম্পানিকে যে করের ফাঁদে পড়তে হয়, তা অনেক সময়েই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লোকসান হলেও কর
বাংলাদেশে যৌথ মূলধনি বা কোম্পানি কাঠামোয় ব্যবসা পরিচালনা করলে কর দিতে হবে– এটা প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, লাভ না হলেও ব্যবসায়িক লেনদেন বা ‘টার্নওভার’ এর ওপর একটি নির্ধারিত হারে কর দিতে হয়, যা ‘টার্নওভার ট্যাক্স’ বা লেনদেন কর নামে পরিচিত।
এটি আসলে কর নয়, একটি নির্দিষ্ট হারভিত্তিক বাধ্যতামূলক কর্তন। ১৯৮২ সালে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ অধ্যাদেশ জারি করে প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘টার্নওভ্যার ট্যাক্স’ বা লেনদেন কর নামে ন্যূনতম করপোরেট ট্যাক্সের এই বোঝা চাপিয়েছিল। নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরার পরও কোনো সরকারই সহজ এই কর আদায়ের পথ থেকে সরে আসেনি। এমনকি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারে দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এই সংস্কারে কোনো আগ্রহ দেখাল না।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ হার শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। অর্থাৎ একটি কোম্পানির বছরে যত টাকার পণ্য বা সেবা বিক্রি হবে, তার ১ শতাংশ কর দিতে হবে– লাভ হোক বা না হোক।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত
এই কর কাঠামোতে সবচেয়ে বিপাকে পড়ছেন নতুন ব্যবসা শুরু করা উদ্যোক্তারা এবং এসএমই খাতের কোম্পানিগুলো। একটি নতুন ব্যবসা সাধারণত প্রথম কয়েক বছর লোকসানে থাকে। তখন তার মূল লক্ষ্য থাকে বাজার ধরার চেষ্টা এবং ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা। কিন্তু শুরুতেই যদি লোকসানের ওপর কর দিতে হয়, তাহলে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরুন, একটি ই-কমার্স কোম্পানি ‘ওয়াই লিমিটেড’-এর বার্ষিক বিক্রি ৩০ কোটি টাকা। প্রচার-প্রচারণা, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও কর্মী ব্যয় মেটাতে গিয়ে তারা বছরে ২ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এরপরও তাদের কর দিতে হবে ৩০ লাখ টাকা, কারণ ১ শতাংশ টার্নওভার কর বাধ্যতামূলক। এই কর দিতে গিয়ে তাদের নগদ প্রবাহে চাপ পড়বে এবং তা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করবে।
আরেকটি বাস্তব উদাহরণ হলো, একটি টেক্সটাইল এসএমই ‘মুন টেক্স’ যার বার্ষিক টার্নওভার ১০ কোটি টাকা। তাদের প্রকৃত লাভ ১০ লাখ টাকা হলেও নতুন কর কাঠামোয় তাদের কর দিতে হবে ১০ লাখ টাকা– অর্থাৎ সম্পূর্ণ লাভটাই চলে যাচ্ছে কর বাবদ।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালা হলো, কর আরোপ হবে মুনাফার ওপর, লেনদেন মূল্যের ওপর নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামসহ প্রায় সব দেশেই এই নীতিই মানা হয়। বাংলাদেশে সেই নীতি উপেক্ষিত হওয়ায় বিশ্লেষকরা একে ‘শাস্তিমূলক কর ব্যবস্থা’ বলছেন। কারণ কোম্পানি যখন ব্যবসার প্রতিটি ধাপে–কাঁচামাল আমদানি, পণ্য উৎপাদন, পরিবহন, বিক্রয়–সবক্ষেত্রে ভ্যাট, শুল্ক, উৎসে করের মাধ্যমে সরকারকে কর দিচ্ছে, তখন লোকসানে থাকার পরও অতিরিক্ত একটি কর আরোপ সংবেদনশীল নয়।
ব্যবসা কতটা টিকে থাকে
বাংলাদেশের যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোর নিবন্ধক (আরজেএসসি) অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। কিন্তু পেশাদার নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইসিএবি বলছে, গত বছর নিরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৫৮ হাজার কোম্পানির। এর মানে বাকিরা হয় ব্যবসা করছে না, অথবা কর নীতির চাপে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্যবসার প্রাথমিক ধাপে টিকে থাকার লড়াইয়ে এই কর কাঠামো বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যারা বড় কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে, তাদের সংখ্যাই বেশি। অথচ দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীর বেশির ভাগেরই যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে।
সরকার বলছে, রাজস্ব আদায়ের হার আশানুরূপ না হওয়ায় বাধ্য হয়েই কর হার বাড়াতে হচ্ছে। কর ফাঁকি রোধ ও বৈষম্য দূর করতে এ সম্পর্কিত বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি যদি বছরে মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশ নগদে করে, তাহলে তার ২৫ শতাংশ করযোগ্য আয় ধরে নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখনও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত নয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের জন্য ব্যাংকিং লেনদেন বাধ্যতামূলক করেনি। ফলে বাস্তবতা উপেক্ষা করে কৃত্রিম করযোগ্য আয় নির্ধারণ করাটা যুক্তিসংগত নয়।
পুঞ্জীভূত মুনাফার ওপর কর: বিনিয়োগে বাধা
আগের বছর মুনাফার ৭০ শতাংশ পুঞ্জীভূত মুনাফা বা রিটেইন্ড আর্নিংসে যোগ করলে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কর দিতে হতো। এবার বলা হয়েছে, চলতি বছরের আয়ের ৭০ শতাংশ রিটেইন করলেও অতিরিক্ত কর দিতে হবে। অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ কোম্পানি পারিবারিক মালিকানাধীন। তারা লভ্যাংশ না দিয়ে পুঁজি হিসেবে মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ করে। এই কর বাধ্যবাধকতা তাদের বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
আজকে টিকলেই আগামীকাল রাজস্ব
বাংলাদেশে রাজস্ব বাড়ানো জরুরি, কিন্তু তা যেন টিকে থাকা ব্যবসাকে হত্যা করে না হয়। যে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান আজ একটি দোকান, সেটাই কাল হতে পারে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। কর কাঠামো হওয়া উচিত এমন– যা ব্যবসাকে টিকতে সাহায্য করে, ধ্বংস করে না। সময় এসেছে কর কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার আনার।
- বিষয় :
- বাজেট