সাক্ষাৎকার
এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে বহু গুণ

.
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৩ | ০০:৫১ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৩ | ০৬:৪১
সমকাল : বাংলাদেশে এলপিজি বাজারের সম্ভাবনা কতটুকু?
রেদোয়ানুর রহমান : বর্তমানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিসহ মোট ৩০টি কোম্পানি দেশে এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ করছে। দেশে এলপিজি শিল্পের বাজারের আকার ৩২০ কোটি ডলারের। তবে এ শিল্পের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দেশে মাত্র ২ শতাংশ উৎপাদিত হয়। দেশে এলপিজির ব্যবহার এক দশকে বহু গুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে ব্যবহার প্রায় ১০ লাখ টনে এবং গ্রাহক সংখ্যাও ৩৮ লাখে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ সালে চাহিদা ছিল মাত্র ৪৭ হাজার টনের। চাহিদা ২০৩০ সালে ৩০ লাখ টনে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সারাদেশে কয়েক হাজার ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে এই বাজারে পরিষেবা দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ মূলত কাতার, কুয়েত ও ইরান থেকে এলপিজি আমদানি করে। অনুমান করা হয়, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে এলপিজির চাহিদা ৩০ লাখ টনে উন্নীত হবে।
সমকাল : বাংলাদেশে এলপিজি বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
রেদোয়ানুর রহমান : বর্তমানে বাংলাদেশে এলপিজি শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক অবকাঠামোর অভাব। যেমন ধরুন, কর্ণফুলী নদীতে মাত্রাতিরিক্ত পলি জমার কারণে বড় জাহাজের বদলে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে টার্মিনালে এলপিজি আনতে হয়। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে এলপিজি বেজ টার্মিনাল চালু হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে যথাযথ লজিস্টিক ও পরিবহন সুবিধা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় গ্যাস পরিবহন এখনও বেশ ব্যয়বহুল। ছোট এলপিজি জাহাজ দেশের নদীপথে চলতে পারলে খরচ কম হতো। কিন্তু দেশের অনেক অঞ্চলে নাব্য সংকটের কারণে এটি সম্ভব নয়। এ কারণে কোম্পানিগুলোকে মোংলা, পায়রা বা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রিফাইনারি পর্যন্ত এবং সেখান থেকে দেশের পরিবেশকদের কাছে ট্যাঙ্কারে করে এলপিজি পরিবহন করতে হয়। এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
সমকাল : এ খাতের উন্নয়নে সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের নীতি সমর্থন আশা করছেন?
রেদোয়ানুর রহমান : ২০০৮ সালে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকেই দেশে গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় এলপিজির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন সেক্টর এলপি গ্যাসে স্থানান্তরিত হওয়ায় এখন বছরে বাজারের আকার ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এলপি গ্যাস দেশের জ্বালানির ৯ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে। বর্তমানে দেশে মোট এলপিজির গৃহস্থালিতে ৮৪ শতাংশ, শিল্পকারখানায় ১২ শতাংশ ও পরিবহন খাতে ৪ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার এলপিজি আমদানি বাড়াতে এবং জনগণের কাছে সুলভ মূল্যে পৌঁছে দিতে বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করছে। যেমন– ২০১৭ সালে ১৫ শতাংশ ডিউটি ফি সম্পূর্ণ মওকুফ করে দেওয়া হয়। অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ ও অগ্রিম কর (এটি) ৩ শতাংশ করা হয়। ২০২১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করে দেয়। সরকার এলপিজি কোম্পানিগুলোর সুবিধার্থে দেশে এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনের ওপর আগের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে।
এই সেক্টরের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং গ্রাহকদের আরও সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি সরবরাহের জন্য মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে ১৫ কোটি ডলারে ৩০ হাজার টন স্টোরেজ ক্ষমতাসহ একটি রেফ্রিজারেটেড এলপিজি বেজ টার্মিনাল নির্মাণাধীন।
আমাদের প্রত্যাশা, এলপি গ্যাসের মূল্য সঠিকভাবে নির্ধারণ ও বাজারে সেই মূল্যে বিক্রি নিশ্চিত করা। ২০০-৩০০ টাকা বেশি মূল্যে সিলিন্ডার বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এমন হলে সাধারণ মানুষ ইলেকট্রিক স্টোভের দিকে চলে যাবে, যা এলপিজি খাতের উন্নয়নকে ব্যাহত করবে। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকর অভিযান চালাতে হবে।
ক্রস ফিলিং বন্ধ করতে হবে। এর কারণে অনেক অবৈধ সিলিন্ডার বাজারে যাচ্ছে, ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ খাতের পরিবহন ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে যেন ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন ব্যাহত না হয়।
এলপিজি একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার, সুতরাং এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত ও নির্ভরযোগ্য করতে হবে। অন্যথায় মানুষ ঝুঁকির কথা ভেবে এলপিজি থেকে দূরে সরে যাবে। নতুন কোম্পানির লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সব নীতি ও নিয়ম মানা হয়েছে কিনা তা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
সমকাল : অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে এলপিজির খুচরা মূল্য প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। আপনি কী মনে করেন?
রেদোয়ানুর রহমান : ভোক্তাদের জন্য এলপিজি সিলিন্ডারের দাম মূলত আমদানি নীতি, এলপিজি স্টেশন লাইসেন্সিং, পরিবহন এবং প্রাসঙ্গিক অবকাঠামোগত খরচের ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া এলপিজি সিলিন্ডারের দাম আমদানি, পরিশোধন, বোতলজাতকরণ এবং বিতরণ খরচের ওপরও নির্ভর করে। অভ্যন্তরীণ বাজারে এলপিজির মূল্য নির্ধারণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো– প্রতি মাসে সৌদি আরামকো নির্ধারিত চুক্তির মূল্য। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা না থাকায় সীমিত এলপিজি আমদানি করতে হয়, যার কারণে স্পট মার্কেটের সঙ্গে সঙ্গে এলপিজির দামও বেড়ে যায়। দেশে পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা থাকলে আমদানিকারকরা বেশি এলপিজি আমদানি করে তা সংরক্ষণ করতে পারতেন এবং স্পট মার্কেটে দাম বাড়লেও সঙ্গে সঙ্গে দেশে দামের ওপর প্রভাব পড়ত না। তা ছাড়া আমাদের দেশের পরিবহন খরচ, আমদানি খরচ ও বাজারজাতকরণ খরচ পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এগুলো বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। তা ছাড়া এখন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বাজারে এলপিজির মূল্য সমন্বয় করা মুশকিল হচ্ছে।
সমকাল : তৃণমূল পর্যায়, যেমন গ্রামে প্রতিনিয়ত গ্রাহক বাড়ছে। এখানে সম্ভাবনা কতটা?
রেদোয়ানুর রহমান : বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে থাকলেও অধিকাংশ অঞ্চলে শতভাগ গ্যাস নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এর মানে হলো, এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবসার জন্য একটি বড় সম্ভাবনাময় বাজার এ দেশে। সঠিক সাপ্লাই চেইন তৈরি করে এসব অঞ্চলের মানুষের কাছে এলপিজি সরবরাহ করতে পারলে দেশে এই বাজার আরও প্রসারিত হবে। গ্রামের মানুষ এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় ব্যয় করে। সুতরাং সবাই ধীরে ধীরে এলপিজির দিকেই ঝুঁকবে। রেস্তোরাঁ খাতের বিকাশের ফলে এলপিজির ব্যবহারও বাড়বে।
এখন কিছু কোম্পানি এলপিজি রপ্তানিও করছে, যা আরও সম্ভাবনার একটি দিক। এই শিল্প খাতকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজার বিবেচনায় রেখে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নতুবা এই অপার সম্ভাবনাময় খাতটি গতিশীলতা হারাবে।
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার
- এলপি গ্যাস