ক্রেতা-বিক্রেতাকেও জবাবদিহির আওতায় আনছে পশ্চিমারা

প্রতীকী ছবি
তাসনিম মহসিন
প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪ | ০০:১২
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বড় বাজার হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক রপ্তানির সিংহভাগ হয় এই দুটি অঞ্চলে। বাংলাদেশসহ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোতে শ্রমের মান ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে বহুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র। এতে খুব ভালো ফল না পেয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে যাচ্ছে তারা।
গত ২৪ এপ্রিল ইইউ পার্লামেন্টে ‘করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ’ (সিএসথ্রি-ডি) বিল পাস হয়। এতে পক্ষে ভোট পড়ে ৩৭৪টি এবং বিপক্ষে ২৩৫টি। ভোট দানে বিরত থাকেন ১৯ জন। এই বিলে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠান ইইউতে ব্যবসা করবে, যাদের বছরে ন্যূনতম বিক্রি ৪৫০ মিলিয়ন ইউরো এবং কর্মী ১ হাজারের বেশি তারা নতুন এই আইনের আওতায় পড়বেন। তাদের অবশ্যই শ্রমিক অধিকার ও শ্রম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, তা না হলে গুনতে হবে জরিমানা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে ইইউ ডেলিগেশন প্রধান চার্লস হোয়াইটলি সমকালকে বলেন, ‘ইউরোপীয় বা অন্য যে কোনো দেশের প্রতিষ্ঠানকে আগামীতে ইইউতে ব্যবসা করতে অবশ্যই মানবাধিকার ও শ্রম পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ইইউর বাজারে ১ হাজার ৬২৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের একক পণ্য রপ্তানির দিক থেকে ইইউর বাজার সবচেয়ে বড়। ফলে ইইউর মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রম অধিকার ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সিএসথ্রি-ডির আওতায় ক্রেতা বা বিক্রেতাকে গুনতে হবে জরিমানা।
ইইউর মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাংলাদেশে আর্থসামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হলেও শ্রম ও মানবাধিকারে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ‘এভরিথিংস বাট আর্মস’-এর (ইবিএ) মূল সনদ মেনে চলার ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর) বাস্তবায়ন; মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং নাগরিক সমাজের দায়িত্ব পালনের সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ২০২৩ সালের ইউপিআরের সুপারিশ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে উৎসাহিত করছে ইইউ।
বাংলাদেশের শ্রম আইন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রম খাতে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) পুরোপুরি বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, সম্মিলিত দরকষাকষি এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে। এসব নিয়ে ইইউ ও আইএলওর উদ্বেগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ বলছে, বিদ্যমান শ্রম আইনে দ্রুতই সংশোধনী আনা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশসহ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেহেতু পোশাকশিল্প মালিকরা রয়েছেন, তাই তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে চাইছে পশ্চিমারা। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পশ্চিমারা শ্রম অধিকার, শ্রমের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। রানাপ্লাজা ধসের ঘটনার পর এ বিষয়ে অনেক অগ্রগতিও হয়েছে। বর্তমানে পরিবেশবান্ধব কারখানা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। তার পরও অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে, যা বাংলাদেশকে চাপে ফেলছে। ফলে ইইউর সিএসথ্রি-ডি ক্রেতার পাশাপাশি বিক্রেতাকেও চাপে ফেলবে।’
এদিকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ডিসেম্বরে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ইউএসটিআরের অনুরোধে এই তদন্ত শুরু করে ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশন (ইউএসআইটিসি)। বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে থাকা অপর চার দেশ কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান ইউএসআইটিসির এই তদন্তের আওতায় পড়েছে। দেশগুলো কীভাবে মার্কিন পোশাকশিল্পের বাজার দখলে রেখেছে, তা খতিয়ে দেখবে ইউএসআইটিসি। এই পাঁচটি দেশের কেউ অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজার দখল করছে কিনা সেটিও অনুসন্ধান করবে কমিশন। এরই মধ্যে গত ১১ মার্চ ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ নিয়ে একটি শুনানি হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সফর করছে ইউএসআইটিসি প্রতিনিধি দল। আগামী ৩০ আগস্ট মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কাছে তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে সুপারিশ করবে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া নিজের দেশের ক্রেতাদের জন্য দেবে দিকনির্দেশনা।
অপরদিকে বাংলাদেশসহ ৬৫টি দেশের জন্য ব্রেক্সিট-পরবর্তী নতুন বাণিজ্যনীতি নিয়েছে যুক্তরাজ্য। এই নীতি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে অস্ত্র ছাড়া সব পণ্য আরও সহজে শুল্কমুক্ত রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ। তবে এক্ষেত্রে জুড়ে দেওয়া হয়েছে শ্রম ও মানবাধিকারের শর্ত। শ্রম অধিকার ও মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হলে এই সুবিধা বন্ধ করে দেবে যুক্তরাজ্য।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাজ্যের বাজারে ৩৮৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
- বিষয় :
- শ্রম অধিকার