ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বছরজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত দেশ

বছরজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত দেশ

.

 জাহিদুর রহমান 

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৪২

টালমাটাল রাজনীতি আর রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মতো বাংলাদেশের প্রকৃতিও ২০২৪ সালে প্রায় পুরো সময় বৈরী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। বছরটা শুরু হয়েছিল তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। এর পর বাংলাদেশের ইতিহাসে উষ্ণতা আর বন্যার রেকর্ডের সঙ্গে ছিল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও। এসব দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ায় আক্রান্ত হন কোটি কোটি মানুষ। বিপদের বড় শিকার দেশের কৃষি খাত। ব্যাপক ক্ষতি হয় অর্থনীতির। প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া এবং এগুলো পরপর ঘটতে থাকাকে পরিবেশবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন।

বছরের শুরুটা হয়েছিল তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। গত জানুয়ারিতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল। এর পর ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মৌসুমের প্রথম তাপদাহ। পরে এপ্রিল মাসের পুরোটা সময় আরেক দফা টানা তাপদাহের কবলে পড়ে দেশ। এর আগে দেশের ইতিহাসে সর্বশেষ ১৯৪৮ সালে এত লম্বা সময় ধরে তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল। এবার এপ্রিলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠানামা করে ৪২ থেকে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। গরমের তীব্রতায় তৈরি হয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয় ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। জনজীবন অতিষ্ঠ করে দেওয়া রেকর্ড তাপদাহে জীবন ও সম্পদের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, নিভে যায় ৯৫ প্রাণ। বিপর্যয়ে পড়ে কৃষি, নেমেছে পানির স্তর। বেঁকে যায় রেলপথ, বিটুমিন উঠে এবড়োখেবড়ো হয় সড়ক। ৪ মের পর এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ফের বাড়তে শুরু করে তাপমাত্রা, যা দফায় দফায় স্থায়ী ছিল জুলাই পর্যন্ত। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের জেরে আগস্টে গরমের কষ্ট কিছুটা কমে। তবে সেপ্টেম্বরের প্রথম ও তৃতীয় সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ প্রবাহিত হয়।
তাপপ্রবাহের সঙ্গে মার্চের শেষ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন জেলায় আঘাত হানে তীব্র শিলাবৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে ঝরা কোনো কোনো বরফখণ্ডের ওজন ছিল ২০০ গ্রামেরও বেশি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে মাসজুড়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে। জুন, জুলাই ও আগস্টেও বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে কালবৈশাখী। এসব ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও ঘটে হতাহতের ঘটনা।

বছরজুড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানলেও ২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ছিল অনেকটাই কম। ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ছয় জেলায় প্রাণ হারান ১০ জন। রিমালের পর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ‘দানা’ নামের ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উড়িষ্যা অঞ্চল দিয়ে উপকূল অতিক্রম করলেও এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোয়। আগস্টে ঘূর্ণিঝড় ‘আসনা’ এলেও তেমন ক্ষতি হয়নি। বছরের শেষ দিকে ৩০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ফিনজালের প্রভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়।
মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে মে মাস থেকে শুরু করে আগস্ট পর্যন্ত দফায় দফায় বন্যায় আক্রান্ত হয় বিভিন্ন জেলা। ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রায় এক কোটি মানুষ। মে মাসের শেষ সপ্তাহ ও জুনে কয়েক দফা আকস্মিক বন্যার সম্মুখীন হয় সিলেট। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ফের বন্যার কবলে পড়ে ১৫-২০ জেলা। তবে ২০২৪ সালের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয় আগস্টের শেষ ১০ দিনে পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় হওয়া বন্যা। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের তথ্যমতে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফেনী, নোয়াখালীসহ ১১টি জেলা। বন্যায় এই জেলাগুলোর ৯০ শতাংশ মানুষ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। ধ্বংস হয় ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। প্রলয়ংকরী এই বন্যায় প্রাণ হারান প্রায় ৬০ জন মানুষ। বন্যায় ১৪ হাজার ৪২১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি। এর পর অক্টোবরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলায় বন্যায় ১০ জনের মৃত্যু হয়। 

কৃষিতে বড় ক্ষতি
আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে দুর্যোগকবলিত দেশের তালিকায় নবম বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে দেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাদের ৪৮ শতাংশের এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই। ওই জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই গ্রামীণ ও কৃষক। একের পর এক দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন পূর্বাভাসের তুলনায় চার লাখ টন কম হতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ। সবজি ও ফলের উৎপাদনের ওপরও প্রভাব পড়ে। ২০২৪ সালে পাঁচ দফা বন্যার কারণে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু দেশের যেসব এলাকায় বন্যা হয়নি, সেখানে উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়েছে। এ বছর আমনে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় তিন টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। যে কারণে সামগ্রিকভাবে চালের উৎপাদন খুব বেশি হেরফের হয়নি। 

 

আরও পড়ুন

×