আদানির সব বকেয়া শোধ, তবে বিরোধ মেটেনি ঢাকার

ছবি: সংগৃহীত
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫ | ০৬:৩৩ | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৫ | ০৯:২৫
কয়লার দাম নিয়ে মতপার্থক্যের মধ্যেই আদানি পাওয়ারের বকেয়া পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। গত মাসে ভারতের কোম্পানিটির বকেয়া ৪৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছে। সরকার বলছে, বিদ্যুৎ আমদানির মূল্য পরিশোধের পাশাপাশি কয়লার দাম নিয়ে আলোচনা ও দরকষাকষি অব্যাহত থাকবে।
আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর চুক্তি করে বাংলাদেশ। ২৫ বছর মেয়াদি ওই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিতে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় ২০০ কোটি ডলার ব্যয়ে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে আদানি পাওয়ার। কেন্দ্রটি থেকে গতকাল বুধবার বিকেল ৪টায় বাংলাদেশ ১ হাজার ৪৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পায়।
ভারতীয় গণমাধ্যম পিটিআই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত জুনে ভারতের এ কোম্পানিকে ৪৩৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ, যা এককালীন সর্বোচ্চ পরিশোধ। নয়াদিল্লির সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, এখন বাংলাদেশের আর কোনো বকেয়া নেই, বরং দুই মাসের বিলের সমপরিমাণ এলসি এবং সব বকেয়ার জন্য সার্বভৌম গ্যারান্টিও বাংলাদেশ দিয়ে রেখেছে। পাওনা-সংক্রান্ত ঝামেলা না থাকায় আদানি পাওয়ারকে তাদের ঝাড়খণ্ড কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকেই নির্ধারিত হারে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি।
ভারতের আরেক সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, গত তিন-চার মাস ধরে ৯০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার করে পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।
কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ
পিডিবির এক সাবেক প্রকৌশলী বলেন, পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কয়লা কেনায় ছাড়ের বিষয়টি রয়েছে। পায়রা ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা কেনার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে দামে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পায়, যার সুবিধা প্রকৃতপক্ষে পিডিবি ভোগ করে। রামপালও বছরজুড়ে কয়লা কেনার সময় ছাড়ের শর্তেই চুক্তি করে। আদানি নিজের খনির কয়লা সরবরাহ করে। তার চুক্তিতে ছাড়ের বিষয়টি নেই।
জানা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমদানি করা কয়লার মূল্য নির্ধারণে ইন্দোনেশিয়ার সূচক ব্যবহার করে। অন্যদিকে আদানি ‘ব্লেন্ডেড ইনডেক্স’ অনুসরণ করে; যা ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসলসহ একাধিক সূচকের সমন্বয়ে তৈরি। এই সূচকের কারণে অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির প্রতি টন কয়লায় দাম ১০ থেকে ১২ ডলার বেশি পড়ছে বলে পিডিবির দাবি।
সংস্থাটি বলছে, এতে বিদ্যুৎ বিলেও বড় ধরনের পার্থক্য হচ্ছে। এই বিরোধ নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে একাধিকবার চিঠি দেওয়া-নেওয়া এবং আলোচনা হয়েছে। গত ২৪ জুন ভার্চুয়াল বৈঠকও করে দুই পক্ষ। তবে কোনো সমাধান হয়নি। ভার্চুয়াল বৈঠকে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আরও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আয়োজনের বিষয়ে একমত হয় উভয় পক্ষ।
অসম চুক্তির বোঝা
শুধু কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ নয়, আদানির সঙ্গে চুক্তি নিয়েই বিপাকে আছে বাংলাদেশ। সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই ব্যবসায়ী রিলায়েন্স ও আদানির জন্য বিদ্যুৎ ব্যবসার বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। মোদির সফরের দুই মাসের মাথায় আদানি পাওয়ারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে পিডিবি। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের ভেতরেই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার প্রস্তাব ছিল প্রতিষ্ঠানটির। তবে সমঝোতার দুই বছর পর ২০১৭ সালে ভারতে একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। দীর্ঘমেয়াদি এই চুক্তির পরতে পরতে অসমতা রয়েছে বলে জানিয়েছিল ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)। ২০২২ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চুক্তিতে এমন অনেক শর্ত আছে, যেগুলোর কারণে ২৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নিয়ে যাবে।
চুক্তি অনুযায়ী, আদানির কেন্দ্র থেকে পিডিবি কখনোই ৩৪ শতাংশের নিচে বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। কম বিদ্যুৎ নিলে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হতো, তার দাম ও কয়লা পরিবহন খরচের অর্থ দিতে হবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার পরিমাণ, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বেশি ধরা হয়েছে। আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কয়লার সিস্টেমলস ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ। দেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর চুক্তিতে এমন বিধান নেই। দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশ সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রায় নেই।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম সমকালকে বলেন, আদানির চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ লঙ্ঘন হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ এবং তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা আনু মুহাম্মদ বলেন, আদানির চুক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না। একটি অন্যায্য চুক্তি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত বছর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগের শাসনামলের আদানিসহ বড় বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে। কিন্তু এই কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বুধবার সমকালকে বলেন, আদানির সঙ্গে চুক্তি যেহেতু হয়েই গেছে, বিদ্যুৎও কেনা হচ্ছে, তাই দাম তো দিতেই হবে। এ জন্য আগের সরকারের রেখে যাওয়া বকেয়া শোধ করা হচ্ছে। কিন্তু কয়লার দাম নিয়ে পিডিবির আপত্তি রয়েছে। বকেয়া শোধ করলেও কয়লার দর নিয়ে আলোচনা চলবে।
- বিষয় :
- আদানি পাওয়ার